WB Politics

গণতন্ত্রের বদলে অধিনায়ক-তন্ত্র?

কার্যক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের সময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে পক্ষপাত, নির্বাচনী ক্ষেত্রে দেখা না মেলা ইত্যাদি নানান অভিযোগ ভারতীয় রাজনীতিতে বা বঙ্গ-রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়।

Advertisement
আবির্ভাব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৪৭

মরিশদা গ্রাম পঞ্চয়েতের প্রধান, উপপ্রধান এবং দলের অঞ্চল সভাপতিকে পদত্যাগ করার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পদত্যাগ করেন প্রধান ঝুনুরানি মণ্ডল, উপপ্রধান রামকৃষ্ণ মণ্ডল এবং দলের অঞ্চল সভাপতি গৌতম মিশ্র। কিন্তু এই তিনটি ইস্তফাকে এক চোখে দেখা মনে হয় ঠিক হবে না। গৌতম মিশ্র দলের অঞ্চল সভাপতি। অন্য দিকে, ঝুনুরানি মণ্ডল এবং রামকৃষ্ণ মণ্ডল কিন্তু একটি পঞ্চায়েতের প্রধান এবং উপপ্রধান। তাঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, দলের প্রতিনিধিমাত্র নন। ইস্তফার আগে ঝুনুরানি মণ্ডল সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিলেন, “৪৮ ঘণ্টা কেন ৪৮ মিনিটেই ইস্তফা দিতে পারি। কিন্তু আমরা তো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।” ঝুনুরানি মণ্ডলের এই কথাটি আমাদের একটু অন্য ভাবে ভাবা দরকার।

আগে দল না কি আগে পদাধিকারীর কর্তব্য—এই বিতর্ক ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন নয়। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়, লোকসভার অধ্যক্ষ হিসেবে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করে দলের রোষানলে পড়েছিলেন। অথচ, খুব সঙ্গত কারণেই এমনটা মনে করা হয়— দলের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নির্বাচনী ক্ষেত্রের সকল মানুষের প্রতিনিধি।

Advertisement

একটি রাজনৈতিক দল প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়, প্রতীক দেয়। প্রার্থী সেই মনোনয়ন নিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাইতে যান। ফলে দলের প্রতি প্রার্থীর যেমন আনুগত্য আছে, দায়বদ্ধতা আছে; ঠিক তেমনই জনগণের প্রতিও তাঁর দায়বদ্ধতা আছে। যে কোনও নির্বাচনে প্রার্থী যে কেবল নিজের দলের সমর্থকের ভোট পেয়েই নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তা নয়। নিজস্ব ভাবমূর্তি, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বিবিধ সমীকরণের উপর নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না-থাকা বহু মানুষের ভোটও তিনি পেতে পারেন। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, তিনি কেবল দলের সমর্থকদের ভোটেই জয়লাভ করে এসেছেন, তার পরও মনে রাখা দরকার তিনি ওই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী ক্ষেত্রের সমস্ত মানুষের প্রতিনিধি।

কার্যক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের সময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে পক্ষপাত, নির্বাচনী ক্ষেত্রে দেখা না মেলা ইত্যাদি নানান অভিযোগ ভারতীয় রাজনীতিতে বা বঙ্গ-রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, ‘জনপ্রতিনিধি নিখোঁজ’ এই মর্মে পোস্টার, কোথাও কোথাও পরিষেবা না পাওয়ার বিক্ষোভও দেখতে পাওয়া যায়। আবার এই কথাও ঠিক যে রাজনৈতিক দলগুলির এগুলি দেখার দায় আছে এবং জনগণের প্রতিও তাদের দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু তার পরও, দলীয় মঞ্চ থেকে দলের এক উচ্চ পদাধিকারীর এই উদ্ধত উচ্চারণের আরও কয়েকটা দিক আছে।

প্রাচীন গ্রিসের চিন্তকগণ অথবা চুক্তিবাদী তাত্ত্বিকরা যাঁরা মনে করেছিলেন মানুষ সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই সার্বভৌমের জন্ম দিয়েছেন, তাঁরাও বলার চেষ্টা করেছেন সার্বভৌম তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তাকে উচ্ছেদের ভারও সেই মানুষদের হাতেই থাকা উচিত। পঞ্চায়েত বা পুরসভা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতীক। এই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তদনুযায়ী, এই সিদ্ধান্ত উপর থেকে না এসে আঞ্চলিক ভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত পদ্ধতিতে হওয়াই কাম্য। গণতন্ত্রের মূল শক্তি যদি জনগণ হয়, সেই জনগণের যদি প্রতিনিধি প্রেরণের অধিকার থাকে— প্রত্যাহারের অধিকারও তাদেরই হাতে।

প্রেরিত জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যাহারের গণতান্ত্রিক কোনও সুযোগ কি ভারতে নেই? আছে এবং নেই। আছে এই অর্থে যে, প্রধান বা সরপঞ্চকে ফিরিয়ে আনার বিধান আছে পঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ-সহ আরও কিছু রাজ্যে। প্রথমে গ্রামসভার মাধ্যমে প্রস্তাব এবং পরে জেলা-শাসকের মধ্যস্থতায় তা সম্পন্ন হতে পারে। পদ্ধতিটি জটিল। প্রকৃতপক্ষে ব্যবহার হয় কি না সে বিষয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু যদি তা এক বারের জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে, তবে মনে রাখা দরকার, তা অত্যন্ত উচ্চতর গণতান্ত্রিক অভ্যাস। নেই এই অর্থে যে, রাজ্য স্তরে বা সর্বভারতীয় স্তরে এযাবৎ সেই সুযোগ নেই।

গণপরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে যে বিতর্ক হয়, অাম্বেডকর তা গ্রহণ করেননি। সংসদে ১৯৭৪-এ জনপ্রতিনিধি প্রত্যাহার বিষয়ে সংবিধান সংশোধনী বিল নিয়ে আলোচনা হলেও, তা পাশ হয়নি। ২০১৬ সালে আবারও বরুণ গান্ধী বিষয়টি প্রাইভেট বিল হিসেবে পেশ করেন। গত দশকের গোড়ায় অণ্ণা হজারে ‘রাইট টু রিজেক্ট’-এর সঙ্গে ‘রাইট টু রিকল’ নিয়েও সরব হন। রাইট টু রিজেক্ট নোটা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলেও, জনপ্রতিনিধি প্রত্যাহারের বিষয়টি গৃহীত হয়নি।

অনস্বীকার্য, স্থানীয় সরকারগুলি তাদের আয়ের জন্য রাজ্য সরকারের উপর নির্ভরশীল। একই ভাবে রাজ্য সরকারগুলিও অর্থনৈতিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু, এই অজুহাত দেখিয়ে কেন্দ্র যেমন রাজ্য সরকারগুলির উপর খবরদারি করলে গণতন্ত্রে আঘাত আসে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন ওঠে; তেমনই রাজ্য সরকারগুলিও স্থানীয় সরকারকে পুতুল হিসেবে গণ্য করলে আসলে গণতান্ত্রিক পরিসরেই ক্ষয় ধরে।

সহজ দলবদলের এই কুটিল সময়ে দাঁড়িয়েও নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে ইস্তফা দিয়ে ঝুনুরানি মণ্ডল, রামকৃষ্ণ মণ্ডল দলের প্রতি আনুগত্যের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু, দলীয় মঞ্চ থেকে দলের উচ্চ পদাধিকারীর এই উদ্ধত উচ্চারণ এবং তার প্রেক্ষিতে ঝুনুরানি মণ্ডলের ওই একটি বাক্য আমাদের এক মৌলিক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়— গণতন্ত্রে মূল ক্ষমতার উৎস কি মানুষ, না কি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও তাদের সর্বাধিনায়কেরা?

আরও পড়ুন
Advertisement