Migrant Workers

যেমন আছেন পরিযায়ীরা

পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারি পরিসংখ্যানের আড়ালে আরও অনেকে লুকিয়ে, খাতায় কলমে যাঁদের কোনও হিসাব নেই।

Advertisement
চৈতালি বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৫১

Sourced by the ABP

কলকাতার প্রেস ক্লাবে সময়োপযোগী একটি আর্থ-সামাজিক সমস্যা নিয়ে এক আলোচনা হয়ে গেল গত সপ্তাহে। দিল্লি ও কলকাতার পরিযায়ী শ্রমিকরা বসবাস ও জীবনযাপনে প্রতিনিয়ত কী ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে চলেছেন, তা নিয়ে এক সমীক্ষাপত্র প্রকাশ করেছে মহানির্বাণ কলকাতা রিসার্চ গ্রুপ (সিআরজি), আলোচনা ছিল সেটি ঘিরেই। সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে কী ভাবে চেনার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে অচেনা, এক অন্য বাস্তব। দিল্লি ও কলকাতা শহরে খেটে-খাওয়া হাজারো তথ্য-পরিসংখ্যানহীন মুখ প্রতিনিয়ত দেশের অর্থনীতির রেখাচিত্র ঊর্ধ্বগামী রেখেছে, সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণি তা নিয়ে অন্ধকারেই পড়ে। সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত, অনালোচিত একটি শ্রেণি এই পরিযায়ী শ্রমিকরা, লকডাউনের আগে পর্যন্ত যাঁদের পরিসংখ্যানটুকু পর্যন্ত দেশের সরকারের খাতায় নথিভুক্ত ছিল না!

Advertisement

পরিযায়ী শ্রমিকদের সরকারি পরিসংখ্যানের আড়ালে আরও অনেকে লুকিয়ে, খাতায় কলমে যাঁদের কোনও হিসাব নেই। পাশাপাশি, এই শ্রমিকেরা নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে আপস করে চলেছেন বাধ্য হয়ে। বিশেষত, মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকেরা বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ বঞ্চনার শিকার হয়ে চলেছেন। কোভিড-উত্তর পর্বে পরিযায়ী শ্রমিকেরা কাজের খোঁজে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন— মূলত দিল্লি ও কলকাতার নির্মাণ শ্রমিক, গৃহপরিচারক, বস্ত্রনির্মাণ শ্রমিক এবং স্বাস্থ্য শ্রমিকদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এই সমীক্ষাটি।

সমীক্ষার নানা স্তর যেন পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারগুলির ক্রমশ অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষয় ও অসুরক্ষিত বার্ধক্যের দিকে হেঁটে যাওয়ার এক জীবন্ত দলিল। সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে কথোপকথনে ফুটে ওঠে তাঁদের প্রতি কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের চরম উদাসীনতা। লকডাউন ও তার পরের হাঁ-মুখ বেকারত্ব থেকে যে দেশের সরকার কোনও শিক্ষা নেয়নি, অসংরক্ষিত কর্মক্ষেত্রে ঠিকাশ্রমিকদের বেতন তথা কর্মসুরক্ষার পরিকাঠামোর বিন্দুমাত্র সংস্কার হয়নি। এই ২০২৪-এও পরিযায়ী শ্রমিকেরা একই অন্ধকারে পড়ে আছেন।

এই সমীক্ষার জন্য মূলত পেশাগত ভিত্তিতে চার ধরনের পরিযায়ী শ্রমিক বেছে নেওয়া হয়েছিল। নির্মাণ শ্রমিক, গৃহপরিচারক, বস্ত্রনির্মাণ শ্রমিক ও স্বাস্থ্য শ্রমিক। দিল্লি ও কলকাতা মিলিয়ে মোট ২৬৬ জন পরিযায়ী শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে; সেখানে ধর্ম, জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গ, বর্ণের মতো বিষয়গুলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তাঁদের ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানের নিরিখে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে। এঁদের মধ্যে ৫৮ শতাংশ কলকাতার, বাকি ৪২ শতাংশ দিল্লিতে কর্মরত। দেখা যাচ্ছে, এঁদের অধিকাংশই রয়েছেন সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থার বাইরে, যে কারণে তাঁরা নিজেদের এলাকা বা গ্রামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে শহরে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ নারী-শ্রমিকেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে কাজ নিচ্ছেন সংসার টানতে৷ বিয়ে করে স্বামীর সংসারে এসে তার পর তাঁদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিকের কাজে যোগ দিতে হচ্ছে— কখনও সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাতে, কখনও দেশের বাড়িতে থাকা পরিবারের অন্নসংস্থানের তাগিদে। আবার, স্বামীর পরিশ্রম ও রোজগারের বোঝা ভাগ করে নিতেও কেউ কেউ শহরে এসে গৃহপরিচারিকা বা ঠিকাশ্রমিকের কাজ করছেন।

সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকদের অধিকাংশেরই কোনও সঞ্চয় নেই, স্বাস্থ্য বিমা নেই। এমনকি, শহরে এসে দিনে আট থেকে দশ ঘণ্টা শ্রম দেওয়ার পরেও মাথার উপরে কোনও স্থায়ী ছাদ নেই। এই সমীক্ষাপত্রে থাকা দিল্লিতে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে আশা (নাম পরিবর্তিত) একমাত্র, যিনি কর্মস্থলের মালিকের সাহায্য ও গ্রামের বাড়ির লোকের অর্থসাহায্য নিয়ে দিল্লি শহর থেকে বাইরে এক টুকরো জমি কিনতে পেরেছেন। কিন্তু আশা ব্যতিক্রম। তাঁকে দেখে বাকি পরিযায়ী শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান বিচার করা নিতান্ত বোকামি হবে। সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই শ্রমিকেরা ব্যাঙ্ক লোন পান না। তাঁদের রোজগার এতটাই কম যে, তা থেকে কোনও সঞ্চয়ও সম্ভব হয় না। ফলে, অসুখবিসুখ বা জরুরি প্রয়োজনে মোটা টাকার দরকার পড়লে অসহায়তাই সম্বল।

অন্য দিকে, কর্মহীনতার কারণেই শহরে এসে পুরুষ পরিযায়ী শ্রমিকেরা দিনমজুরের কাজে যোগ দিচ্ছেন। দিল্লিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ঠিকাশ্রমিকের কাজে আসেন। আর কলকাতায় পরিযায়ী শ্রমিকেরা আসছেন এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে— মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, বীরভূম, দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া।

গবেষণা বলছে, রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক সামাজিক প্রকল্প না থাকাও এই পরিযায়ী শ্রমিকদের বৃদ্ধির পিছনে অনেকাংশে দায়ী। পাশাপাশি, দেশের গ্রামীণ এলাকার উন্নতি হচ্ছে না, সেখানকার মানুষেরা শহরজীবনের সুযোগ-সুবিধা নিতে শহরে ভিড় জমাচ্ছেন। তাতে গ্রামের মানুষ পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হলেও, বিদ্যুৎ সংযোগ, জলের সুবিধা, পাকা সড়ক, অবিচ্ছিন্ন পরিবহণ ব্যবস্থার হাতছানি উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শহরে এসেও মানুষগুলি শৌচাগার, পরিস্রুত পানীয় জলের অভাবে ভুগছেন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, ঘিঞ্জি বস্তি এলাকায় কোনও মতে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।

কোভিডের পরে যে এঁদের অবস্থা বদলেছে, এমনটা একেবারেই নয়। তাঁদের পেটে এখনও খিদে, জীবনযাপন এখনও চরম অনিশ্চিত। সকলের পায়ে এখনও চটিজোড়াও জোটে না। সময়ের প্রলেপে লকডাউনের স্মৃতি ধূসর হওয়ায় আমরা তাঁদের ও তাঁদের শিশুদের মাইলের পর মাইল খালিপায়ে হাঁটার দৃশ্যটি ভুলে যেতে পেরেছি মাত্র।

আরও পড়ুন
Advertisement