চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

হিংস্র পশু নয়, শক্তি ও যন্ত্রণার প্রতীক

আইসিসিআর-এ অনুষ্ঠিত শ্যামকানু বরঠাকুরের প্রদর্শনীটি দেখলেন মৃণাল ঘোষ।প্রয়াণের এক বছর পর তাঁর স্ত্রী জয়িতার উদ্যোগে ‘হ্যালো হেরিটেজ’-এর পক্ষে রেশমি চট্টোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় তাঁর ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে সম্প্রতি আইসিসিআর-এ অনুষ্ঠিত হল প্রদর্শনী। অনেক কাজ ছিল সেখানে অনেক দিনের করা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১

শ্যামকানু নামেই সকলে তাঁকে চিনত। কেউ কেউ শুধুই শ্যাম। ‘বরঠাকুর’ পদবিটা যেন বাহুল্য ছিল। মনে থাকত না অনেকেরই। ঝকঝকে কথা বলতেন। উৎসাহ, উদ্যম, উদ্যোগ সব কিছু মিলিয়ে যৌবনের দীপ্তি ছিল শেষ পর্যন্ত। কিছু দিন অসুস্থতার পর হঠাৎই যখন চলে গেলেন ২০১৪ সালে, তখনও বিশ্বাস হতে চাইছিল না ষাট-বছর বয়সে পৌঁছে গেছেন তিনি। তাঁর এই অকাল-প্রয়াণ মর্মাহত করেছিল শুধু তাঁর কাছের মানুষদেরই নয়, সমস্ত শিল্পানুরাগীকেই। আরও অনেক কিছু পাওয়ার ছিল তাঁর কাছ থেকে। ছবি আর ভাস্কর্য করতেন অজস্র ধারায়। সব কাজেই সংহত থাকত ভিতরের শক্তি। তাঁর নিজের যৌবনই যেন প্রতিধ্বনিত হত।

প্রয়াণের এক বছর পর তাঁর স্ত্রী জয়িতার উদ্যোগে ‘হ্যালো হেরিটেজ’-এর পক্ষে রেশমি চট্টোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় তাঁর ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে সম্প্রতি আইসিসিআর-এ অনুষ্ঠিত হল প্রদর্শনী। অনেক কাজ ছিল সেখানে অনেক দিনের করা। চলে যাওয়ার কিছুদিন আগেরও কয়েকটি ছবি ছিল। চেতনা তখন ছায়াচ্ছন্ন। কথা বলতে পারেন না। ঠিকমতো চিনতেও পারেন না সকলকে। স্বাক্ষর করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। অথচ রং-তুলিতে ছবিটি গড়ে তোলার ক্ষমতায় ভাটা পড়েনি এতটুকু। যৌবনের দীপ্তি সে-সব ছবিতেও স্পষ্ট। স্বাক্ষরহীন সেরকম কয়েকটি বিস্ময়-জাগানো ছবি দেখার সুযোগ হল এই প্রদর্শনীতে।

Advertisement

শিল্পী: শ্যামকানু বরঠাকুর।

শ্যামকানুর ছবি ও ভাস্কর্যে একটি বিষয় বারবার রূপায়িত হয়েছে। তা হল বিভিন্ন পশু। এর মধ্যে বরাহ প্রাধান্য পেয়েছে। তবে তাঁর পশু নিছক পশুর প্রতিকৃতি নয়। একে তিনি রূপায়িত করেছেন স্ফুরিত এক শক্তি, যন্ত্রণার প্রতীক হিসেবে।

আলতামিরা গুহার দেয়ালে যে আদি মানুষ বাইসন এঁকেছিল, সে তো সেই ছুটন্ত পশুর প্রতীকে তার তীব্র জীবনস্পৃহা বা বাঁচার তাগিদকেই রূপ দিতে চেয়েছিল। আমাদের কৃষাণ বা গুপ্তযুগের যে বুদ্ধমূর্তি, তাও তো দীপ্ত মানবিক প্রজ্ঞারই প্রতীক। মিকেলেঞ্জেলোর ‘পিয়েতা’, ভ্যানগঘের ‘সূর্যমুখী’ বা অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ – সবই তো কোনও না কোনও আদর্শের বা ধ্যানের প্রতীক। প্রজন্মের পর প্রজন্মে এই প্রতীকের চরিত্র পাল্টায়। সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে শিল্পীর চেতনার যে রসায়ন, তা থেকেই নির্ধারিত হয় প্রতীকের চরিত্র। পরিবর্তন যেমন আছে সেখানে, তেমনি থাকে কিছু অপরিবর্তনীয় মূল্যবোধ বা প্রকাশরীতিও। ঘোড়া, ষাড় বা বাইসন তো কত শিল্পীই এঁকেছেন। আদিম মানুষ থেকে শুরু করে পিকাসো, চৈনিক শিল্পী জুঁ পেয়, হুসেন বা আমাদের কলকাতার সুনীল দাস পর্যন্ত। বিষয় এক থেকেছে কিন্তু কালভেদে, শিল্পীভেদে অর্থ পাল্টেছে, অভীপ্সা পাল্টেছে।

শ্যামকানু যখন বরাহ, বা হাতি আঁকেন, তখন তিনি তাঁর ভিতরের যে ক্ষোভ, শক্তির অভীপ্সা, ভেঙে পড়া মূল্যবোধের জন্য আর্তি এসবেরই প্রতীক-রূপ গড়ে তুলতে চান। অসমে ছেলেবেলা থেকে বনজঙ্গল দেখেছেন, নানাবিধ পশুপাখি দেখেছেন। তাঁর মনের মধ্যে স্থায়ী ছাপ ছিল সেসবের। নিজের সৃজনের ক্ষেত্রে এলেন যখন, সেইসব স্মৃতি মূর্ত রূপ পেতে লাগল। কিন্তু তাঁর চেতনার তাপে রূপান্তরিত হল সেসমস্ত রূপাবয়ব। তাঁর নিজস্ব প্রতিবাদীচেতনার সংহত প্রতীক হয়ে উঠল সেগুলো।

১৯৭৬-এ অসম থেকে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করেছেন। শিল্পকলার শিক্ষা নিয়েছেন কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে। নিজস্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এলেন যখন, তখন তাঁর মগ্নচেতনায় যে আদিমতার উৎস সঞ্চিত ছিল, সেই উৎস থেকে নিঃসৃত হতে লাগল প্রতিমাপুঞ্জ। রেখা ও ছায়াতপে গড়ে উঠতে লাগল সংহত শক্তির প্রতীকরূপ। কখনও তাতে মত্ততা এসেছে, কখনও বা জড়তার সঙ্গে জঙ্গমতার দ্বান্দ্বিক সংঘাত, ক্কচিৎ কখনও স্নিগ্ধ প্রশান্তিও, যেমন তাঁর ছাগলের রূপায়ণে। সব মিলে তিনি তাঁর নিজের সময় ও জীবনবোধের প্রতীক তৈরি করে গেছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement