চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

সময়ের স্রোতে বয়ে চলে যে জীবন

মিরেজ আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।কোনও একক পরিচয়ে কি চিহ্নিত করা যায় কোনও মানুষকে? মানুষের কি কোনও স্থির-নির্দিষ্ট আত্মপরিচয় বা আইডেন্টিটি আছে? মানুষ একই সঙ্গে অনেকগুলো পরিসরে বাঁচে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৬ ০০:৪৩
শিল্পী: চন্দ্র ভট্টাচার্য।

শিল্পী: চন্দ্র ভট্টাচার্য।

কোনও একক পরিচয়ে কি চিহ্নিত করা যায় কোনও মানুষকে? মানুষের কি কোনও স্থির-নির্দিষ্ট আত্মপরিচয় বা আইডেন্টিটি আছে? মানুষ একই সঙ্গে অনেকগুলো পরিসরে বাঁচে। আবার সভ্যতা, সমাজ ও জীবন যত জটিল হয় মানুষের অবস্থানের এই ভিন্ন পরিসরের মধ্যে সংঘাত ততই বাড়ে।

এই দ্বান্দ্বিকতা থেকেই মানুষের সত্তা ক্রমবিবর্তিত হয়। ক্রমশ হয়ে ওঠার দিকে অগ্রসর হয়। এই হয়ে ওঠা একটা প্রক্রিয়া। এর কোনও শেষ সীমা নেই। এর মধ্যেই মানবসত্তা অশেষকে ধারণ করে। কিন্ত পার্থিবতার সংঘাত থেকে তার কোনও মুক্তি নেই।

Advertisement

অস্তিত্বের অন্তর্গত পরিসরের ব্যাপ্তির কথা মনে রেখে ছ’জন শিল্পীর কাজ নিয়ে একটি প্রদর্শনী উপস্থাপিত হয়েছে সম্প্রতি মিরেজ আর্ট গ্যালারিতে। যার শিরোনাম: ‘কালের প্রবাহ — পরিবর্তমান পরিসর’। এটি পরিকল্পনা বা কিউরেট করেছেন অয়ন মুখোপাধ্যায়।

ছ’জন শিল্পী হলেন: আদিত্য বসাক, অতীন বসাক, চন্দ্র ভট্টাচার্য, দেবনাথ বসু, জয়শ্রী চক্রবর্তী ও প্রশান্ত সাতু।

আদিত্য বসাকের রচনাটির শিরোনাম ‘দ্য নস্টালজিক পাস্ট অ্যান্ড দ্য প্রেজেন্ট’। কলকাতার সাংস্কৃতিক অতীত ও বর্তমানের দুটি পরিসরকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন কাগজের উপর মিশ্রমাধ্যমে আঁকা প্রতিটি পর্বে পাঁচটি করে ছবিতে। ঊনবিংশ শতকের ধর্মীয় পরিসরের প্রেক্ষাপটে আজকের মৃত্যুময় সংঘাতের পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করেছেন।

অতীন বসাক কাজ করেছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি শিশুর বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে। তাঁর রচনাটির শিরোনাম: ‘আ নিউ-বর্ন টুডে আ বয় টুমরো — দ্য এভলিউশন প্রসেস ইন টাইম’। প্রথমে তিনি দেওয়ালের উপর বিভিন্ন বয়সের শিশুদের দিয়ে ছবি আঁকিয়েছেন। সেই প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছেন বোর্ডের উপর মিশ্রমাধ্যমে আঁকা নিজের প্রায় ১৪ টি ছবি।

সদ্যোজাত শিশু থেকে শুরু করেছেন। তার পর এনেছেন তাদের পাঠ-পক্রিয়া। সেখানে ‘এ’-তে আজ পূর্ণ আপেল হয় না। ‘বি’ বলের বদলে হয় ‘বার্গার’। তার পর আসে ‘ছোটা ভীম’ আর স্পাইডারম্যানের জগৎ।

শৈশবের পরিসরে এই যে আন্তর্জাতিকতার অনুপ্রবেশ নামান্তরে যা মার্কিনী ধনতন্ত্রের আগ্রাসন, পরিণত পর্বে তা এক বিপন্ন সত্তার উৎসারণ ঘটায়।

চন্দ্র ভট্টাচার্যের বহু মুখাবয়ব সমন্বিত বৃহদাকার মিশ্রমাধ্যমের ক্যানভাসটির শিরোনাম ‘বিটুইন দ্য সেল্ভস’।

আত্মস্বরূপের অজস্র রূপকে তিনি পাশাপাশি সন্নিবিষ্ট করেছেন। আঁধার-জড়িত একটি বড় মুখাবয়ব এর পাশে, আর তাকে ঘিরে অজস্র বর্গাকার ছোট ছোট মুখ ও অস্তিত্বের নানা আভরণ।

এই মুখগুলোকেই আবার তিনি আলাদা করে ছড়িয়ে দিয়েছেন, এক একটি স্বতন্ত্র চিত্রপট হিসেবে। এই নিয়ে রচনাটি একটি ইনস্টলেশনের সমগ্রতা পায়। এই যন্ত্রণাক্ত অজস্র পরিচয়ের মধ্যে কোনও কি একান্ত আত্মপরিচয় আছে আজকের মানুষের? এটাই যেন শিল্পীর প্রশ্ন।

দেবনাথ বসু’র মিশ্রমাধ্যমে করা পাশাপাশি সন্নিবিষ্ট সাতটি বিস্রস্ত, বিমূর্ত, রূপাবয়বের শিরোনাম: ‘মেমোরিজ, শেপস অ্যান্ড শেডস অব টাইম’।

সময়ের স্রোতে প্রবহমান স্মৃতি ক্রমাগত রূপান্তরিত হয়। সত্তার সঙ্গে তা সংযোগ হারিয়ে ফেলে। এই বিশ্লিষ্ট স্মৃতিরই নানা কিমাকার রূপকে ধরতে চেয়েছেন শিল্পী।

কাগজের বোর্ড কেটে গড়া এই রূপাবয়বের ভিতর রয়েছে অজস্র সূক্ষ্ম কারুকাজ, যা জীবনের প্রবহমানতার ইঙ্গিত বহন করে।

জয়শ্রী চক্রবর্তীর রচনার বিষয়ও স্মৃতি। স্মৃতির দুটি পরিসরের মধ্যে সম্পর্ক ও সংঘাত।

শৈশবের গ্রামীণ পরিমণ্ডলের স্মৃতির সঙ্গে আজকের নাগরিক পরিপার্শ্বের স্মৃতির সংলাপ। যা থেকে জেগে ওঠে কল্পরূপ।

এই কল্পরূপের ভিতরই চলে আত্মস্বরূপের সন্ধান। দশটি মিশ্রমাধ্যমের ছোট ছবির সমন্বয়ে গড়া চিত্রমালার শিরোনাম: ‘আ পার্ট অ্যাপার্ট’। এখানেও বিচ্ছিন্নতার সমস্যা।

জীবনধারার বিভিন্ন অংশের মধ্যে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা। কর্মী মানুষদের কর্মিষ্ঠতা নিয়ে কাজ করেছেন তিনি, যে কর্মিষ্ঠা কোনও প্রকল্পকে সম্পূর্ণ করে অথচ কর্মী মানুষটি থাকে তা থেকে বিচ্ছিন্ন।

একটি সভায় চেয়ার সাজায় যে শ্রমিক বা কুড়ুল দিয়ে কাঠ কেটে কোনও নির্মাণ প্রকল্পকে সম্পূর্ণ করে যারা, সমগ্রের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাই তাদের ভবিতব্য। এই বিচ্ছিন্নতা আধুনিকতার অনিবার্য পরিণতি।

আরও পড়ুন
Advertisement