চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে ধরা পড়ল দুই বাংলার প্রদর্শনী

অ্যাকাডেমিতে ‘প্রাচী প্রতীচী’ শীর্ষক সম্মেলক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।প্রাচী প্রতীচী একটি শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চামূলক সংগঠন। গড়ে উঠেছিল ১৯৯৯ সালে। তার পর থেকে নানা প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছে এই সংস্থা। সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল একটি সম্মেলক প্রদর্শনী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০০

প্রাচী প্রতীচী একটি শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চামূলক সংগঠন। গড়ে উঠেছিল ১৯৯৯ সালে। তার পর থেকে নানা প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছে এই সংস্থা। সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল একটি সম্মেলক প্রদর্শনী।

বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজ এখানে আমাদের খুব বেশি দেখার সুযোগ হয় না। সেদিক থেকে এই প্রদর্শনী অনেকটা গুরুত্ব বহন করে। এই বাংলা ও ওই বাংলার চিত্র চর্চার মধ্যে খুব বেশি ব্যবধান নেই। কেননা একই উত্‌স থেকে প্রবাহিত হয়েছিল দুটি ধারা। বিভাজন ঘটেছে ১৯৪৭-এর পর। উত্‌সে ছিল তিনটি রূপ : স্বাভাবিকতাবাদী চিত্ররীতি, প্রাচ্য চেতনার উদঘাটন ও পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী বিশ্লেষণাত্মক আঙ্গিক। এই তিনের সমন্বয়ে নিজের মত বিশ্লেষণ ও প্রসারিত করে আত্ম আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন দুই দেশের শিল্পীরাই। বাংলাদেশের ভাষা-আন্দোলন, ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তার পর স্বাধীন দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবস্থান বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রকাশে ভিন্ন মাত্রা এনেছে। কিন্তু ব্যাপক কোনও ব্যবধান আনেনি।

Advertisement

এক দিকে নৈসর্গিক সজলতা, অন্য দিকে অভিব্যক্তিমূলক বিমূর্তায়ন - বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজে বেশি দেখা যায়। কাইউম চৌধুরীর ছবিতে রেখার বিন্যাসে গড়ে উঠেছে যে নারীমুখ বা রফিকুল নবী’র ছবিতে শাবক-সহ পক্ষীমাতার জলাশয় থেকে মত্‌স সংগ্রহের যে রূপকল্প, তা নৈসর্গিক সজলতার দৃষ্টান্ত। অন্য দিকে শাহাবুদ্দিন আহমেদ আঁকেন মুখোমুখি দুটি ঘোড়ার যে সংঘাতের ছবি তাতে থাকে অভিব্যক্তিমূলক বিশ্লেষণাত্মক জঙ্গমতা। আলোকেশ ঘোষ একেঁছেন জলরঙে অজস্র কাকের সমবেত উপস্থিতি। আহমেদ শামসুদ্দোহা একেঁছেন নদীতীরে নৌকার নিসর্গ। দুটিতেই রয়েছে সকল প্রকৃতির-মুগ্ধতা। অন্য দিকে জামাল আহমেদ বা রণজিত্‌ দাসের ছবিতে বিশ্লেষণাত্মক বিপন্নতার আভাস। বাংলাদেশের অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন শেখ আফজল, মুনিরুজ্জামান, দুলালচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ।

এ প্রান্তের চিত্র - ভাস্কর্যে ১৯৬০ থেকে একবিংশ শতক পর্যন্ত বিবর্তনের কিছু আভাস ধরা আছে। বিপিন গোস্বামীর ভাস্কর্যে পাই আদিমতা-সম্পৃত্তি অভিব্যক্তিবাদী বিশ্লেষণ। শঙ্কর ঘোষ উন্মীলিত করেছেন ধ্রপদী চেতনা। নিরঞ্জন প্রধানের ব্রোঞ্জে রয়েছে ঐতিহ্যদীপ্ত পুরাণকল্পের অনুসঙ্গ। মানিক তালুকদার, অসীম বসু, বিমল কুণ্ডু, সোমনাথ চক্রবর্তী, অনিল সেন, সন্দীপ চক্রবর্তী, প্রভাত মাঝি, কিঙ্কর সাহা ঐতিহ্যেরই নানা দিকে আলোকপাত করেছেন তাঁদের কাজে। নতুন ভাবনা ও আঙ্গিকের প্রকাশ অখিল চন্দ্র দাস, মৃণালকান্তি গায়েন, সুব্রত পাল, তাপস বিশ্বাস ও ভবতোষ সুতার-এর ভাস্কর্যে।

ছবিতে প্রয়াত ও প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন ইন্দ্র দুগার, পরিতোষ সেন, বিজন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার, গণেশ পাইন এবং রবীন মণ্ডল, সুহাস রায়, গণেশ হালুই, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, লালুপ্রসাদ সাউ, যোগেন চৌধুরী, সুনীল দাস, মনু পারেখ প্রমুখ। তাঁরা প্রায় সকলেই ১৯৬০ -এর দশকের প্রতিনিধি স্থানীয় শিল্পী। ভারতের আধুনিকতাবাদী চিত্রকলার স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় উঠে এসেছে তাঁদের কাজে। সত্তরের শিল্পীদের মধ্যে বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন জহর দাশগুপ্ত ও দেবব্রত চক্রবর্তী। ‘চারুলতা’ বিষয়ক তাঁর ছবিটির আঙ্গিকে জহর সন্ধান করেছেন স্বতন্ত্র এক ভারতীয়তা। জলরঙে দেবব্রত আনতে চেয়েছেন প্রান্তিক জীবনের অস্তিত্বের সংকট।

সুব্রত চৌধুরীর মুখোমুখি যুদ্ধরত দুই মহিষাসুরমর্দিনীর রূপায়ণটিতে রয়েছে পুরাণকল্পের ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা। স্নিগ্ধ স্বাভাবিকতাবাদী রূপায়ণে সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করেন। মনোজ দত্ত এঁকেছেন ফুলদানিতে ফুলের ছবি। অশোক মল্লিকের ব্যাঘ্রারূঢ়। এ রকম ঐতিহ্যগত প্রবণতা থেকে কিছু দূরে অবস্থান করেছেন তরুণ দে। তাপস সরকারের ছবিটিতেও এ রকম প্রয়াস। একবিংশ শতকে ‘বিকল্প রূপ কল্পে’র যে নতুন উন্মেষ, তার কোনও দৃষ্টান্ত এই প্রদর্শনীতে নেই। অন্যান্য যে সব শিল্পী প্রচলিত প্রবণতাকে অনুসরণ করেছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন শেখর কর, রূপচাঁদ কুণ্ডু আশিস রেহমান, শ্যামল মুখোপাধ্যায়, পার্থ ভট্টাচার্য, সুব্রত সেন, প্রসেনজিত্‌ সেনগুপ্ত, তপন পাঠক, অনুস্বর প্রমুখ।

আরও পড়ুন
Advertisement