পুস্তক পরিচয় ২: বাংলাদেশের বই

সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে সমন্বয়ের ধারা

স্মৃতিচারণামূলক এই বইয়ে বুলবুল চৌধুরীর নাট্যশৈলী ও প্রতিভার যেমন বিবরণ আছে, তেমনই পাওয়া যায় আফরোজার দীর্ঘ জীবনের সংগ্রাম ও নানা ঘটনা। এক দিকে বর্ণময় শৈশব-কৈশোরে নৃত্যচর্চা ও সাধনায় সমর্পণ, অন্য দিকে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত ইতিবৃত্ত খুবই মনোগ্রাহী ভঙ্গিতে উপস্থাপনা করেছেন তিনি।

Advertisement
আবুল হাসনাত
শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
সুন্দর এই পৃথিবী আমার,আফরোজা বুলবুল। অ্যাডর্ন পাবলিশার্স, ১১০০.০০

সুন্দর এই পৃথিবী আমার,আফরোজা বুলবুল। অ্যাডর্ন পাবলিশার্স, ১১০০.০০

চল্লিশের দশকে উপমহাদেশের কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে প্রতিভা মোদকের। এই মিলন, সখ্য ও পরস্পরনির্ভরতার ফলেই সম্ভব হয়েছিল বুলবুল চৌধুরীর অনন্য নৃত্য উপস্থাপনা। কয়েকটি নৃত্যনাট্য তাঁদের যুগল সৃষ্টিও। জন্মসূত্রে নারায়ণগঞ্জের এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মেয়ে প্রতিভা মোদক, বিয়ের পর হন আফরোজা বুলবুল। বুলবুল চৌধুরীর স্ত্রী, ছায়াসঙ্গী এবং সব নৃত্যকর্মের প্রেরণাদাত্রী। আফরোজার শিল্পসাধনার ইতিবৃত্ত সংবলিত একটি গ্রন্থ হাতে না এলে আমরা জানতেই পারতাম না কী অসামান্য প্রতিভাময়ী ও সংস্কৃতি-অনুরাগী ছিলেন তিনি। কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাঁর মানস গঠন, শৈশব থেকে সংগীতে পাঠ এবং অনুশীলন তাঁর জীবন ও পথযাত্রাকে শিল্পময় করে তুলেছিল। পরিচয়ের পর বুলবুল চৌধুরী আমন্ত্রণ জানান তাঁর নাচের দলে যোগ দিতে। পরে ১৯৪৩ সালে প্রতিভা মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে আফরোজা বুলবুল নামে পরিচিত হন।

স্মৃতিচারণামূলক এই বইয়ে বুলবুল চৌধুরীর নাট্যশৈলী ও প্রতিভার যেমন বিবরণ আছে, তেমনই পাওয়া যায় আফরোজার দীর্ঘ জীবনের সংগ্রাম ও নানা ঘটনা। এক দিকে বর্ণময় শৈশব-কৈশোরে নৃত্যচর্চা ও সাধনায় সমর্পণ, অন্য দিকে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত ইতিবৃত্ত খুবই মনোগ্রাহী ভঙ্গিতে উপস্থাপনা করেছেন তিনি। তাঁর গদ্যও স্বাদু। খুব সহজেই বর্ণনার গুণে পাঠক গ্রন্থটির অন্তর্নিহিত আবেদনের স্বাদটি ভিন্ন মাত্রা নিয়ে উপলব্ধি করেন। আফরোজার জীবনব্যাপী সাধনার গল্পটি পাঠ করে হৃদয়-মন যেমন আর্দ্র হয়ে ওঠে, তেমনই এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এই গ্রন্থটি আফরোজা শেষ করে যেতে পারেননি। ১৯৯০ সালে লন্ডনে তাঁর মৃত্যু হয়। গ্রন্থটির শেষের অংশ লিখেছেন মায়ের হয়ে তাঁর কন্যা।

Advertisement

বুলবুল চৌধুরী তাঁর নৃত্যদল নিয়ে ভারতবর্ষ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, ইউরোপ, আমেরিকা সহ পৃথিবীর বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন। বুলবুল চৌধুরীর জন্ম হয় বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। কিন্তু নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা পান কলকাতায়। অকালপ্রয়াত না হলে তিনি ও তাঁর দল নৃত্যশৈলীতে যে সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছিলেন, তা যে উচ্চতা অর্জন করত, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। বাঙালি মুসলমান সমাজে নৃত্য ও নৃত্যনাট্যের সৃজন কল্পনা এবং কাহিনির বর্ণনায় তিনিই পথিকৃৎ। বুলবুল চৌধুরী চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে বিকাশমান শিক্ষিত মুসলিম সমাজে আলোড়ন তুলেছিলেন, এঁদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার এই অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে খুব সহজেই মুসলমান সমাজ নিজেদের ভিন্ন আদলে চিনতে পেরেছিল। বুলবুল চৌধুরী যখন কলকাতায় আলোড়ন সৃষ্টি করছেন, তখন উদয়শঙ্করও তাঁর নৃত্যদল নিয়ে খ্যাতির শিখরে। সেই পর্বে নৃত্যের ভুবনে আলাদা আসন অর্জন করা কম কথা নয়।

নৃত্যদল নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণ শেষে অসুস্থ শরীরে যখন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন, তখন তিনি কপর্দকশূন্য। অর্থ যা পেয়েছিলেন, দলের ভ্রমণ, শো ও ব্যয় নির্বাহ করতেই সব শেষ হয়ে যায়। নাচ পরিবেশন করে প্রতিশ্রুত সব অর্থ পেয়েছেন, তাও নয়। এই অধ্যায়টি খুবই মর্মস্পর্শী। দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে ভুগে তিনি ছোট তিনটি সন্তান রেখে মাত্র ৩৫ বৎসর বয়সে মারা যান ১৯৫৪ সালের ১৭ মে, কলকাতায়। বুলবুলের মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া আফরোজা জীবনের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। নৃত্যের চর্চাকে শত বিরূপতার পর ত্যাগ করেননি। পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে বুলবুলের স্মৃতিতে ঢাকায় গড়ে তোলেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা)। এই বাফা তমসাচ্ছন্ন এক সময়ে পূর্ব বাংলায় সাংস্কৃতিক জাগরণে অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করেছিল।

এক দিকে আফরোজা তিনটি সন্তানকে মানুষ করতে স্বামীর অকালমৃত্যুর পর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। অন্য দিকে চালিয়েছেন নৃত্যের সাধনা। ট্রুপ নিয়ে বিদেশেও নৃত্য পরিবেশন করেছেন। পেয়েছেন প্রশংসা ও সম্মান। বুলবুল চৌধুরী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মান্ধতার কারণে যে বিরূপতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, আফরোজা তাঁর সাধনা ও নৃত্য চর্চার মধ্য দিয়ে হয়তো সেটা জয় করতে পেরেছিলেন।

এই গ্রন্থে পাই ছেলেবেলাতেই আফরোজা কলকাতার বিভিন্ন কলেজ ও সংস্থার অনুষ্ঠানে নাচ-গান-অভিনয়ে যোগ দিয়েছেন। প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী সাধনা বোস তাঁকে বোম্বে চলচ্চিত্রজগতে নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি কিছু দিন অভিনয় ও সংগীতে অংশ নেন। পরে চলচ্চিত্র ভাল না লাগায় তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং নৃত্যকেই প্রধান অবলম্বন করেন।

শৈশব ও কৈশোর মানসযাত্রায় যে ছাপ রাখে, আফরোজার জীবনেও তা খুবই অর্থময় হয়ে উঠেছিল। আফরোজা বুলবুলের প্রথম নৃত্যগুরু হরিসাধন গুপ্ত। কলকাতা বেতারে কাজি নজরুল ইসলামের কাছে বসে গান শেখার সৌভাগ্যও হয়েছে। এই যে প্রতিভা মোদক বিয়ের পর আফরোজা বুলবুল নাম ধারণ করে বুলবুল চৌধুরীর ছায়াসঙ্গিনী হলেন, স্বামীর ছায়ায় বৃহত্তর বৃত্তেও তিনি যে অসামান্য এক শিল্পী ছিলেন, এ তথ্য হারিয়ে গিয়েছিল।

এই গ্রন্থে বিস্তৃত পটভূমিতে তৎকালীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ছবি পাই, অন্য দিকে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়েরও এক মানবিক ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন
Advertisement