চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

সীমান্ত প্রহরায় দায়িত্ব এড়ায়নি সারমেয়টিও

স্টুডিও ২১-এ অনুষ্ঠিত ‘অন বর্ডারস’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।স্টুডিও ২১-এ অনুষ্ঠিত ‘অন বর্ডারস’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০১

এক সময় সারা বিশ্ব জুড়েই মানুষের চলাচলের জন্য কোনও সীমান্তের বাধা ছিল না। প্রাচীন কাল থেকে সমুদ্র-পর্বতের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত করেছে। এই অভিবাসনের প্রক্রিয়াতেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে একাত্মতা তৈরি হয়েছিল। বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক সমন্বয় সাধিত হয়েছিল। তারপর একদিন ক্ষমতা বিস্তারের অনিবার্য পরিণামে মানুষে মানুষে, দেশে দেশে বিভাজন এসেছে। বিভাজিত বিশ্বে অজস্র সীমান্ত তৈরি হয়েছে। ঔপনিবেশিকতা যেমন অন্যের সীমান্তকে উপেক্ষা করেছে, তেমনি গড়ে তুলেছে নতুন নতুন সীমান্ত। যুদ্ধ, ধনতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মৌলবাদও মানুষে মানুষে বিভাজন প্রক্রিয়ায় সীমান্তকে বাড়িয়েছে যেমন, তেমনি সৃষ্টি করেছে সীমান্ত জুড়ে নিরন্তর সংঘর্ষ। সীমান্ত হয়ে উঠেছে হিংসা, ধ্বংস ও বিপর্যয়ের উৎস। নানাভাবে প্রভাবিত করেছে মানুষের জীবনযাপনের নানা প্রক্রিয়াকে।

স্টুডিও ২১-এ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী, শিরোনাম ‘অন বর্ডারস’। এটি উপস্থাপন করেছে কলকাতার গ্যেটে ইনস্টিটিউট। বার্লিনের একটি আলোকচিত্র সংস্থা OSTKREUZ- এর আলোকচিত্রীরা এই ছবিগুলি তুলেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সীমান্ত-সমস্যার স্বরূপ সন্ধান ও বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে।

Advertisement

আলোচ্য প্রদর্শনীতে ন’জন শিল্পীর বিশ্বের নানা অঞ্চলের সীমান্ত-উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে তোলা ছবি আমরা দেখতে পাই।

থমাস মেয়ার তুলেছেন ‘এক্সাইল ইন ক্যালকাটা’ শিরোনামে ১৯৪৭-এ বাংলা বিভাজন ও ১৯৭১-এর বাংলাদেশ গড়ে ওঠার প্রতিক্রিয়ায় কলকাতার এখনকার বিভিন্ন পরিস্থিতির ছবি।

উদ্ধব মণ্ডল বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিল এক সময়। এখন সে ‘সিকিউরিটি গার্ড’-এর কাজ করে। ছবিতে তাঁকে দেখা যাচ্ছে নিজের ঘরের ভিতর দাঁড়ানো অবস্থায়। সীমান্তের ওপারের বেদনাদায়ক স্মৃতি ভুলে সে কলকাতাতেই থেকে যেতে চায়। বাবলু মোল্লাও আশ্রয় নিয়েছিল এদেশে। এখন সে মুরগি কেটে মাংস বিক্রির ব্যবসা করে। প্রবাস তার কাছেও আজ নিজ-বাস হয়ে উঠেছে। কল্যাণী মণ্ডল একজন যৌনকর্মী। তার মদ্যপ বাবা বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার আগে তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল মেয়ে পাচারকারীদের কাছে। সীমান্ত তার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করেছে এভাবে। ছবিতে কল্যাণীকে দেখা যাচ্ছে যৌনপল্লিতে তার নিজের ঘরে। এরকম নানা স্তরের মানুষের মধ্যে দেশ-বিভাজনের ফলে আজকের প্রতিক্রিয়া অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন শিল্পী।

ইতালির প্রাতোয় মধ্যযুগ থেকেই কাপড়ের পোশাক তৈরির একটি কেন্দ্র ছিল। এই পেশায় যুক্ত ছিলেন বহু মানুষ। ১৯৯০-এর পর থেকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তাঁরা পিছিয়ে গেছেন। চিনদেশের মানুষ এসে অধিগ্রহণ করেছে তাঁদের ব্যবসা। তাঁদের বিপর্যয়ের ছবি তুলেছেন জোরডিস আন্তোনিয়া স্ক্লোসার।

উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া বিভাজিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। সীমান্ত জুড়ে আজও সেখানে সৈন্যরা পাহারা দেয়। নিরন্তর গোলাগুলি চলে। সেই সীমান্ত সংঘর্ষের নানা দৃশ্যের ছবি তুলেছেন জর্গ ব্রুগগেখান।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশের বিভাজনকে উপেক্ষা করে আজও অনেক মানুষ তুর্কি ও গ্রিসের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করতে চায়। সেটা প্রতিহত করার জন্য গড়ে উঠেছে নানারকম নজরদারি ব্যবস্থা। এরই বিভিন্ন ছবি তুলেছেন জুলিয়ান রোডার। এর মধ্যে দুটি ছবি মনে রাখার মতো। দুটিই উত্তর গ্রিসের। প্রথমটি থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা। বৃহদাকার একটি ক্যামেরার সীমান্ত নজরদারির আলেখ্য। দ্বিতীয়টি ‘ট্র্যাকিং ডগ’। পরিপুষ্ট একটি কুকুর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে সীমান্তের দিকে। পিছনে বিস্তীর্ণ জলাশয় ও বনানী। আর এক ধরনের নজরদারি চলে সমুদ্র ও আকাশ পরিব্যাপ্ত করে। সমুদ্রে মোটর-বোট। আকাশে বিমান। চারপাশে দিগন্তব্যাপ্ত নির্জনতা। সীমান্ত-প্রহরার কত ব্যাপ্ত আয়োজন!

আরও পড়ুন
Advertisement