শিল্পী: সুব্রত চৌধুরী
‘আকার’ নামে সংস্থার উদ্যোগে আইসিসিআর-এর বেঙ্গল গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল অভিনব এক সম্মেলক প্রদর্শনী। অভিনব এ কারণে যে ১৩ জন শিল্পীকে নিয়ে এই আয়োজন, তাঁদের সকলেরই নাম সুব্রত। তাই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘আমাদের সুব্রত’। এরকম একটা ভাবনা থেকেও যে একটা সম্মেলক পরিকল্পিত হতে পারে, এর পূর্ববর্তী কোনও নজির আছে কিনা, জানা নেই। এদের মধ্যে তিনজন ভাস্কর, বাকি সকলে চিত্রী। ভাবতে ভালই লাগে, এত জন ‘সুব্রত’ পাশাপাশি কাজ করছেন এই কলকাতায়। সকলেই স্বভাবত স্বতন্ত্র। আর তা থেকে উঠে আসে এখনকার রূপকল্পের বিস্তৃতির একটা চালচিত্র। শিল্পীরা মোটামুটি তিনটি প্রজন্মের অন্তর্গত। ১৯৫০, ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে তাঁদের জন্ম। ঐতিহ্যগত আঙ্গিকেই কাজ করেছেন সকলে। প্রচ্ছন্ন একটা আধ্যাত্মিকতার সন্ধান রয়েছে প্রায় সকলের কাজে। সময়কে নিয়ে সংশয় বা প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ রয়েছে মাত্র দু’জন শিল্পীর কাজে।
ভাস্কর্যগুলোই আমরা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারি প্রথমে। সুব্রত বিশ্বাস তাঁর ব্রোঞ্জগুলিতে এক স্বতন্ত্র ঘরানা তৈরি করেছেন। তাতে লৌকিকের ছোঁয়া আছে। শৈশবের কৌতুকময় খেলার জগৎ থেকে তিনি তুলে এনেছেন বিষয়। আয়তনকে সংহত করে একটু ‘গ্রটেস্ক’ বা কিমাকারের দিকে নিয়ে গেছেন। ‘কিক মিক’ নামের রচনাটিতে শিশুর সঙ্গে খেলা করছে একটা কাঠবেড়ালি। ‘বার্ড লাভার’-এ পাখিকে দু’হাতে জড়িয়ে আদর করছে একটি শিশু। অনবদ্য সারল্যময় তাঁর ছ’টি রচনা। সুব্রত পালের ছ’টি ব্রোঞ্জে প্রাধান্য পেয়েছে সাঙ্গীতিক ছন্দ। বেহালা বাজাচ্ছে দীর্ঘায়ত অবয়বের একজন, সমস্ত শরীরটাই তানপুরা হয়ে উঠেছে এক মানবীর, এ রকম তাঁর বিষয়। সব ক্ষেত্রেই অবয়বের ভিতর এনেছেন ছন্দিত বিন্যাস। সুব্রত কর্মকারের ছ’টি রচনা ব্রোঞ্জ ও মিশ্রমাধ্যমে। দীর্ঘায়ত অবয়বে তিনিও আনতে চেষ্টা করেছেন আধ্যাত্মিক মগ্নতা। দু’একটি রচনায় কাঠের সঙ্গে ব্রোঞ্জ মিলিয়ে প্রকরণের অভিনবত্ব এনেছেন।
ছবিতেও প্রায় সকলেরই রয়েছে ছ’টি করে কাজ। সুব্রত চৌধুরী বোর্ডের উপর অ্যাক্রিলিকে কাজ করেছেন। এক স্বপ্নের মানবী তাঁর প্রতিটি ছবিরই বিষয়। সেই স্বপ্নিলতায় দ্বৈত-সত্তার মধ্যে নীরব সংলাপ চলে। ‘মাস্ক’ ছবিটিতে বসে থাকা প্রায় নিদ্রিতা নারীর সামনে ভূমিতে পড়ে আছে একটি মুখোশ। অন্য পাশে একটি ছিন্ন হাত। ‘ওয়েটিং’ ছবিতে রজনীগন্ধা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে এক যুবতী। অবয়বের ভিতর দিয়েই কল্পমায়ার এক নিজস্ব জগৎ তৈরি করেন সুব্রত চৌধুরী।
স্বাভাবিকতার আঙ্গিকে অত্যন্ত বিদগ্ধ শিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়। রামকিঙ্কর, যামিনী রায় ও প্রণব মুখোপাধ্যায় এই তিন জন ব্যক্তিত্বের মুখাবয়ব চিত্রে অসামান্য দক্ষতা ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। নব্য ভারতীয় ঘরানার দিগদর্শনের প্রকাশ রয়েছে কয়েক জন শিল্পীর ছবিতে। সুব্রত ঘোষ এঁকেছেন বুদ্ধ, শিব, গণেশ ও রাধাকৃষ্ণের প্রতিমাকল্প। সুব্রত পাল স্বপ্নিলতার ভিতর দিয়েই গড়ে তুলেছেন কিশোরীর খেলার জগৎ। ‘স্প্রিং’ নামের একটি ছবিতে ফুলের আবহের মধ্যে দড়ি নিয়ে লাফাচ্ছে একটি মেয়ে। এ রকমই স্নিগ্ধ তাঁর ছবির পরিমণ্ডল। সুব্রত দাস ভারতীয় ধ্রুপদী স্বাভাবিকতায় এঁকেছেন কৃষ্ণ ও রাধা-কৃষ্ণের যুগল আলেখ্য। নীলিম বর্ণপ্রয়োগে অতীতের এক গ্রামীণ সংস্কৃতি উঠে এসেছে তাঁর ছবিতে। সুব্রত কর তন্ত্র-আশ্রিত বিমূর্ততার দিকে গেছেন। অশ্বত্থ পাতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন বিশেষ এক মোটিফ বা প্রতিমাকল্প হিসেবে। বৃত্তাকারে সাজানো মাছ ও জলের ভিতর পদ্মপাতার বিন্যাসে করা রচনাটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের দৃষ্টান্ত। সুব্রত সাহা গভীর বর্ণে এঁকেছেন আয়তনময় গ্রামীণ পরিমণ্ডলের মানবীর ছবি। ফুল হাতে বা পাখা নিয়ে বসে আছে নারী এ রকম তাঁর ছবির বিষয়। সুব্রত শঙ্কর সেনের ছবিতেও ঐতিহ্যগত আঙ্গিকের পরিচয় আছে। কিন্তু একে তিনি মিলিয়েছেন প্রতিচ্ছায়াবাদী পরিমণ্ডলের সঙ্গে। জলাশয়ে ভাসছে পদ্মপাতা, ফুটে আছে ফুল, এ রকম একটি নিসর্গচিত্রে তাঁর মননের শ্রেষ্ঠ পরিচয় ধরা থাকে।
ক্যালকাটা পেইন্টার্স দলের সঙ্গে যুক্ত সুব্রত সেনের ছবিতে সাম্প্রতিকের আধুনিকতাবাদী সংকটের কিছু পরিচয় আছে। ‘হনুমান অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ ছবিতে তিনি আধুনিকতার সঙ্গে পুরাণকল্পকে মিলিয়েছেন। সুব্রত সাহার অনামা অ্যাক্রিলিকগুলি কিছুটা অতিরিক্ত ছায়াচ্ছন্নতায় আবৃত।