শিল্পীদের বিভিন্ন ছবির কোলাজ
পুণের আনবাউন্ড স্টুডিয়ো ও কলকাতার স্টুডিয়ো ২১-এর যৌথ উদ্যোগে স্টুডিয়ো ২১-এ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল ‘কনটিনিউয়াম’ শিরোনামে দশ জন শিল্পীর ভিডিয়ো প্রদর্শনী। ‘আনবাউন্ড স্টুডিয়ো’ পুণে-ভিত্তিক একটি শিল্পী সংগঠন যাঁরা দৃশ্যকলার বিভিন্ন বিষয়ে সম্মেলক ভাবে নানা প্রকল্পে কাজ করে, শিল্প ও জীবনের বহুমুখী নিরীক্ষা যার উদ্দেশ্য। ‘কনটিনিউয়াম’ সে রকমই একটি প্রকল্প। এখানে শিল্পীরা আত্মগত নানা বিষয়ে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি ইতিহাস ও সামাজিক সমস্যার উপরেও আলোকপাতের চেষ্টা করেছেন।
উত্তর-আধুনিক ‘কনসেপচুয়াল’ শিল্প-কার্যক্রমে ভিডিয়ো আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-মাধ্যম। চিত্র বা ভাস্কর্য ভাবনার যে বহুমাত্রিক জটিলতাকে প্রকাশ করতে পারে না, ভিডিয়ো সেই অনালোকিত পরিসরে আলো ফেলতে পারে, কেননা তা কালপ্রবাহকে ব্যবহার করতে পারে এবং একই সঙ্গে অনেকগুলি দৃষ্টিকোণকে রূপবদ্ধ করতে পারে। আলোচ্য প্রদর্শনীর ভিডিয়োগুলিতে এর নিজস্ব পরিসরটিকে নিয়ে এক এক জন শিল্পী এক এক ভাবে পরিস্ফুট করেছেন। ১৯৬৫ সালে পাশ্চাত্যের দুই শিল্পী নাম জুন পাইক ও অ্যান্ডি ওয়ারহোল প্রথম দৃশ্যকলার একটি মাধ্যম হিসেবে ভিডিয়ো তৈরি করেছিলেন। তারপর থেকে তা নানা ভাবে বিবর্তিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। আমাদের দেশে ভিডিয়ো চর্চার শুরু ১৯৯০-এর দশক থেকে। অনেক শিল্পীর নিরন্তর চর্চায় এখানেও ভিডিয়ো একটি সমৃদ্ধ পাদপীঠ তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে দেশীয় বাস্তবতার সমন্বয় ঘটিয়েছে।
আলোচ্য প্রদর্শনীতে এই সমন্বয় প্রয়াসেরই নানা দিক অনুসৃত হয়েছে। দৃশ্যের স্বাভাবিকতায় স্থিত থেকে অন্তর্চেতনাকে উন্মীলিত করেছেন অনেক শিল্পী। শিল্পীরা সকলেই তরুণ বা তরুণী। প্রতিটি রচনা দুই থেকে ছয় মিনিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
বৈভব শা-এর রচনাটির শিরোনাম ‘স্মাইলোরেক্সিয়া’। শিল্পী দেখাতে চেষ্টা করেছেন কী করে মুখের অভিব্যক্তিকে মনের অভিব্যক্তি থেকে আলাদা করে নেওয়া যায়। অন্তর্ব্যক্তিত্ব ও বহির্ব্যক্তিত্বের দ্বৈতের মধ্যে প্রথমটিরই স্বরূপ নির্ধারণ করতে চেষ্টা করেছেন। এই অধরাকে ধরা খুবই কঠিন। পর্দায় ভেসে ওঠে পাশাপাশি তিনটি মুখ। একই মুখের তিন রকম অভিব্যক্তি। মুখটি শিল্পীর নিজের। আবহে সুরেলা সানাই বাজতে থাকে। তিনটি মুখের অভিব্যক্তির রূপান্তর ঘটে। পর্দায় প্রতিফলিত হতে থাকে কবিতা-প্রতিম এক একটি বাক্য, যার ভিতর দিয়ে শিল্পী তাঁর নিজের ভাবনা প্রকাশ করেন।
বাপটিস্ট কোয়েলহো-র রচনার শিরোনাম ‘ইফ ইট উড ওনলি এন্ড’। ১৯৮৪-র ১৩ এপ্রিল থেকে সিয়াচেন গ্লেসিয়ার-এর দখল নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতকে মনে রেখে তিনি তৈরি করেছেন এই ভিডিয়ো। কিন্তু এখানে সৈন্য নেই, যুদ্ধ নেই। আছে শুধু সৈন্যদের ব্যবহারের নানা সামগ্রী, খাদ্যবস্তু, প্রসাধন সামগ্রী, জামাকাপড় থেকে শুরু করে দু’একটি আগ্নেয়াস্ত্রও। আছে ছন্দিত ভাবে তাদের চলাচল এবং ক্রমান্বয়ে অন্তর্হিত হয়ে যাওয়া। অনবদ্য প্রতীকী এক উপস্থাপনা।
অদিতি কুলকার্নির ‘ইনসোমিয়া’ শীর্ষক রচনাটিতে ঘুম আর জাগরণের মধ্যবর্তী উদ্বায়ী অবস্থাকে বিশ্লেষিত করার চেষ্টা হয়েছে আপাত বিচ্ছিন্ন মন্তাজের প্রবাহের মধ্য দিয়ে। আজকের জীবনে প্রতিকারহীন কিছু মনস্তাত্ত্বিক সংকটকে আভাসিত করার চেষ্টা হয়েছে।
প্রভাকর পাচপুটে-র রচনার শিরোনাম ‘আর্থওয়র্ক অব হাদাস্তি’। মহারাষ্ট্রে তাঁর নিজের গ্রাম চন্দ্রপুর কী ভাবে ক্রমে ক্রমে নিকটবর্তী কয়লাখনির গ্রাসে সমস্ত সবুজ হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে গেল তারই করুণ ধারাভাষ্য তৈরি করেছেন শিল্পী ক্রমান্বিত চিত্রিত অঙ্কনের মধ্য দিয়ে।
পারমিতা দাসের ‘ক্লাউড লাইক আ ক্যামেল’ রচনায় দুই নারী, মা ও মেয়ের মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত, আত্ম ও অপরের মধ্যবর্তী শূন্য পরিসর বিশ্লেষণের চেষ্টা হয়েছে। মোনালি মেহের-এর ‘ব্লু নস্টালজিয়া’ রচনায় সমগ্র ছবিটি জুড়ে দেখা যাচ্ছে একটি মেয়ের মাথা ও চুল ম্যাসাজের দৃশ্য। শিল্পীর অভিষ্ট যে আত্মগত শূন্যতার বিশ্লেষণ তা কিন্তু একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তিতে সম্পূর্ণ পরিস্ফুট হতে পারেনি।
এ ছাড়াও প্রদর্শনীতে ছিল অমল পাতিলের ‘অ্যাসাইলাম ফর ডেড অবজেক্টস’, চিন্ময়ী পটেলের ‘২৩.০৬.১২’, সব্রিনা অসবোর্নের ‘লুক বোথ ওয়েজ’ ও উমা রায়ের ‘লস্ট অ্যান্ড রাশিং পাস্ট’ শীর্ষক ভিডিয়ো।