চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

রূপের কারুকাজে পাথরের খাঁজে ঘুমন্ত সাপ

সম্প্রতি চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত গোপীনাথ রায়ের একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষসম্প্রতি চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত গোপীনাথ রায়ের একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১

গোপীনাথ রায় ভাস্কর্যের রূপ ও ভাবে নতুন বোধের সঞ্চার করেছেন। তাঁর ভাস্কর্যগুলি ছোট আকৃতির এবং চিত্রপ্রতিম। অনেক বিমূর্ত বোধকে তিনি ভাস্কর্যে ধরতে পারেন। সঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছেন এক সময়। সঙ্গীতের সুর ও লয়কে ত্রিমাত্রিকতার মধ্যে ধরেছেন। সুরের রূপায়ণ যে কেবল কোনও ব্যক্তি সঙ্গীতযন্ত্র বাজাচ্ছে বা গান গাইছে – তা নয়। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে সুরকে ধরার বিরল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন তাঁর একটি পর্যায়ের রচনায়। ভারতীয় ভাস্কর্যের একটি প্রবণতা আছে, যেখানে তা চিত্রধর্মী। বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে মন্দিরগাত্রে ভাস্কর্যের যে প্যানেলগুলি থাকে দ্বিমাত্রিকতা ও ত্রিমাত্রিকতার কী অসামান্য সমাহার সেখানে! ভারহুত থেকে কোণারক পর্যন্ত ভাস্কর্য তৈরি হয়েছিল সামনে থেকে দেখার জন্য। পিছনের দিকটাকে শিল্পী অদৃশ্যই রাখতে চেয়েছেন। আবার মথুরা বা গুপ্তযুগে প্রগাঢ় ত্রিমাত্রিকতার চর্চাও হয়েছে। দক্ষিণ-ভারতের নটরাজ মূর্তি ত্রিমাত্রিক রূপায়ণের অসামান্য এক দৃষ্টান্ত। গোপীনাথ সব সময়ই ভাস্কর্যের চিত্রলতার উপর জোর দিতে চেয়েছেন। এর একটা কারণ হয়তো নিসর্গের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা।

চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর একক ভাস্কর্যের প্রদর্শনী। পাথর কেটে ২০-টিরও বেশি চিত্রল-ভাস্কর্য নিয়ে করা এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘পাথর ও জল’। পাথর কঠিন, জল তরল। তবু প্রবহমান জল ধীরে ধীরে পাথরকে ক্ষয়িত করে। তার রূপে রূপান্তর আনে। সেই রূপান্তরকে বলা যায় প্রকৃতির ভাস্কর্যরচনা। গোপীনাথ পাথরের উপর জলের মতোই পেলবতায় ও সূক্ষতায় অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। নির্মাণ করেছেন নিসর্গ-সদৃশ এক একটি রূপ। যা অনেকটা গীতিকবিতার মতো। তাঁকে বলা যেতেই পারে ভাস্কর্যের একজন গীতিকবি।

Advertisement

ভারতের আধুনিক ভাস্কর্যে প্রথম পর্যায়টা ছিল স্বাভাবিকতাবাদী অবয়ব ও প্রতিকৃতি-ভিত্তিক। কারমাকার, ফণীন্দ্রনাথ বসু থেকে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী পর্যন্ত এই ধারাটা চলেছে। আধুনিকতাবাদী ভাস্কর্যের প্রথম পথিকৃৎ রামকিঙ্কর। তিনিও জোর দিয়েছেন ত্রিমাত্রিকতার উপর। চিত্রল-ভাস্কর্যের প্রথম রূপকার বলা যেতে পারে মীরা মুখোপাধ্যায়কে। ভাস্কর্যে নিসর্গ-রূপায়ণে তাঁর অবদান অসামান্য।

শিল্পী: গোপীনাথ রায়।

সেই পরম্পরায় কাজ করে গোপীনাথ যে সফলতা অর্জন করেছেন, রূপের সেই উদ্ভাবন তাঁর একান্ত নিজস্ব। ছোট আকারের পাথর নিয়েছেন তিনি। বেশি রভাগই কালো। দু’একটি হাল্কা-বাদামি। সেই পাথরের উপর তুলি-চালনার মতোই চালিয়েছেন ভাস্কর্যের অস্ত্র। গড়ে উঠেছে এক একটি চিত্রল-ভাস্কর্য। প্রকৃতির ব্যাপ্তি ও নিবিড় নিরীক্ষণ যেখানে প্রধান সুর।

প্রকৃতির প্রতি এই শিল্পীর নিবিড় ভালবাসা আছে। আর্ট কলেজের অধ্যাপনা থেকে তিনি সদ্য অবসর নিয়েছেন। এখন সেই অবসরকে ভরিয়ে তুলেছেন সৃজনময়তায়।

‘আইল্যান্ড’ শীর্ষক রচনাটি প্রকৃত অর্থেই পাথর ও জলের সমাহার। পাথরের উপরিতলে নদীর মতো জলের প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। কলকল করে প্রবাহিত হচ্ছে ছলছল জল। মাঝখানে একটি দ্বীপ জেগে উঠেছে। প্রস্তরীভূত সেই দ্বীপের সঙ্গে প্রবাহিত জলের নিভৃত সংলাপ এই রচনাটির বিষয়। ‘রেলওয়ে’ নামের রচনায় পাহাড়ের উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে রেললাইন। ‘এ ব্রোকেন উইঙ্গ’ শুধুই একটি পাখির ছিন্ন ডানা। আমরা যদি নিবিড়ভাবে একটি পাখির ডানাকে নিরীক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাব প্রকৃতি সেখানে রূপের কী অসামান্য কারুকাজ করেছে! সেই কারুকাজই শিল্পী তাঁর ভাস্কর্যে পরিস্ফুট করেছেন। ‘ফ্রগ’—একটি ব্যাঙের রূপায়ণ। চোখদুটি উজ্জ্বল। মাথার উপর থেকে পিঠ পর্যন্ত সূক্ষ্ম রেখার কারুকাজ। পিছনে ও নিম্নভাবে বিশদের উপর তত জোর দেননি শিল্পী। সেখানে রাখতে চেয়েছেন পাথরের সঙ্গে ব্যাঙের অবয়বের এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। ‘হাইবারনেশন’-এ গড়েছেন একটি ঘুমন্ত সাপ পাথরের খাঁজের মধ্যে। সাপের শরীরের সেই তৈলাক্ত স্পর্শময়তাকে পাথরের অমসৃণতার সঙ্গে মিলিয়েছেন। সাপের সঙ্গে ব্যাঙের লুকোচুরি খেলাকে রূপ দিয়েছেন ‘অ্যাটেম্পট্’ নামের রচনায়। ‘দ্য রিভার’-এ দেখছি নদীর প্রবহমানতা। আর ‘রেইন’-এ অঝোরে বৃষ্টি হয়ে যাওয়া। প্রকৃতির বাইরের রূপের সঙ্গে শিল্পী তাঁর অন্তর্দৃষ্টিকে মিলিয়েছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement