পুস্তক পরিচয় ২: বাংলাদেশের বই

বহিরঙ্গে নাগরিক অন্তরঙ্গে অতৃপ্ত

প্রাবন্ধিক হিসেবে আবদুল হক (১৯১৮-১৯৯৭) বাংলাদেশে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি গত শতকের বিশের দশকের মুসলিম সাহিত্য সমাজের চেতনানুসারী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন চিন্তা ও যুক্তির মধ্যে দিয়ে।

Advertisement
আবুল হাসনাত
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৬ ০০:৪৯
আলোয়-আঁধারে, রফিক আজাদ। বেঙ্গল পাবলিকেশন্‌স, ১২০.০০

আলোয়-আঁধারে, রফিক আজাদ। বেঙ্গল পাবলিকেশন্‌স, ১২০.০০

প্রাবন্ধিক হিসেবে আবদুল হক (১৯১৮-১৯৯৭) বাংলাদেশে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি গত শতকের বিশের দশকের মুসলিম সাহিত্য সমাজের চেতনানুসারী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন চিন্তা ও যুক্তির মধ্যে দিয়ে। বুদ্ধির মুক্তির আলোচনা ও শিখা গোষ্ঠীর আন্দোলন এবং আদর্শগত চেতনা তাঁর সাহিত্যবোধে ও সমাজভাবনায় সঞ্চারিত হয়েছিল। ষাটের দশকে তিনি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে লেখনী ধারণ করেন। এই জাতীয় চেতনা ও স্বাজাত্যবোধ পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে বৃহৎ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৩ সালে তিনি বাংলা ও বাঙালি প্রশ্নে মাসিক সমকাল সাহিত্য পত্রিকায় যে প্রবন্ধ লেখেন তাতে তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা ও প্রাবন্ধিক সত্তার পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই সময় থেকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে নিজস্ব মত প্রকাশ করেন। বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে মুসলিম মানসের যে কোনও বিরোধ নেই, বরং মুসলমান পরিচয়ের চেয়েও সাংস্কৃতিক দিক থেকে যে বাঙালিত্বের সাধনা প্রধান, সে কথাই জোর দিয়ে বলতে চেয়েছিলেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তাঁকে একক ও নিঃসঙ্গ অগ্রদূত বলা যায়। নাট্যকার, নাট্য অনুবাদক, সমালোচক, ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যে বিশিষ্ট। তবে বিস্তর লেখালেখি সত্ত্বেও তিনি ছিলেন প্রচ্ছন্নে থাকা মানুষ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্জন করেছেন অনেক পরে। আবদুল হকের আমার জীবনকথা/ স্মৃতিকথা ও দিনলিপি প্রকাশিত হয়েছে একুশের বইমেলায়। সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন আহমাদ মাজহার, যাঁর লেখা আবদুল হকের জীবনী বাংলা একাডেমি থেকে ২০০১-এ প্রকাশিত হয়েছিল। আবদুল হকের পর্যবেক্ষণ যে কত গভীর ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ছিল তা এই গ্রন্থটির বিভিন্ন অংশ পাঠ করলে বোঝা যায়। এই অঞ্চলের মুসলমানদের জাতীয়তার প্রশ্নে কত যে দোলাচল ছিল তা তিনি আশ্চর্য নির্মোহ ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেছেন। সে জন্য এই দিনলিপিতে ব্যক্তিমানুষকে যেমন খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনই তা হয়ে ওঠে সমাজ বিবর্তনেরও এক বিশ্বস্ত দলিল। ব্যক্তির আত্মকথন না হয়ে এটি হয়ে উঠেছে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের মানস বিবর্তনেরও ইতিহাস।

সম্পাদক তাঁর ভূমিকায় আবদুল হকের বিস্তারিত পরিচয়, ব্যক্তিত্ব ও তাঁর প্রবন্ধে চিন্তা ও চেতনার কথা উল্লেখ করেছেন।

Advertisement

গত শতকের ষাটের দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি রফিক আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে স্বাক্ষর বলে এক ক্ষীণজীবী পত্র প্রকাশ করে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন ভিন্ন আদর্শ ও ভিন্ন রুচির কয়েকজন কবি। এঁদের আক্রমণাত্মক, অবক্ষয়ী, শ্লেষাক্ত, বিবরচেতনালগ্ন ক্ষুব্ধ কণ্ঠ ও রচিত কবিতা তৎকালীন পূর্ব বাংলার কাব্যের অঙ্গনকে দীপিত করলেও অগ্রজরা এঁদের চিৎকার ও অভিব্যক্তিকে মেনে নেননি। পরে ‘না’ গোষ্ঠীভুক্ত কবিকুল একই ধারায় কবিতা রচনায় উদ্যোগী হন।

আবদুল হক। কথাপ্রকাশ, ৩০০.০০

এঁদের আদর্শের সঙ্গে কলকাতার হাংরি জেনারেশনের সাযুজ্য ছিল। তবে স্বাক্ষর কিংবা ‘না’ গোষ্ঠী অচিরকালের মধ্যে তাদের ভাবাদর্শ থেকে সরে আসে। হাংরি আন্দোলন নিয়ে বইপত্র প্রকাশিত হলেও বাংলাদেশের এই ভাবাদর্শের কবিদের নিয়ে কোনও আলোচনা চোখে পড়েনি। আসলে গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝির পর থেকে তৎকালীন বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন স্বাজাত্যবোধ ও বাঙালিত্বের সাধনাকে ভিন্ন এক আদল দেয়। এই সময় থেকে শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে উত্তাল আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের পথ নির্মাণ করে। এই আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে কবিরাও ভাষা, কাব্যরীতি ও বোধের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা করেন।

কবি রফিক আজাদও সূচনাকালে যে কাব্যাদর্শকে ধারণ করেছিলেন তা থেকে সরে এলেন। হয়ে উঠলেন সংযতবাক এবং পরিমিতিতে উজ্জ্বল সমাজসচেতন এক কবি। তিনি মুক্তিযুদ্ধেও যোগ দেন। পরে সামাজিক অসঙ্গতি দেখে আহত, ক্ষুব্ধ হয়ে কখনও রূঢ় উচ্চারণ করেছেন বটে— ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব’, কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল শিশুর মতো সরল। এই দ্বন্দ্বময় পৃথিবীতে বাস করেও তিনি বুকে লালন করতেন এক নির্বিরোধ পৃথিবী। বহিরঙ্গে নাগরিক হয়েও তিনি অন্তরঙ্গে ছিলেন এক অতৃপ্ত মানুষ। তাঁর কবিতায় নানা ভাবে নিসর্গ প্রতিফলিত। সম্প্রতি নীরবে-নিভৃতে চলে গেলেন ষাটের দশকের দুর্দান্ত, দুর্বিনীত, আত্মদর্পিত স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর কবি রফিক আজাদ। ১৯৭৩-২০১৫ পর্বে তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশটি।

বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ আলোয়-আঁধারে। রাজনৈতিক সংকটকালে তিনি লিখেছেন প্রতিবাদী কবিতা। তবে তা ইস্তাহারধর্মী নয়। এই গ্রন্থে তাঁর কাব্যভাবনা ও মৃত্যুচেতনা, নিসর্গভাবনা প্রাধান্য বিস্তার করেছে।

আরও পড়ুন
Advertisement