পুস্তক পরিচয় ১

বঙ্কিমকে ফের মন দিয়ে পড়া জরুরি

বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাপত্র নিয়ে আমরা বিতর্কপরায়ণ। বঙ্কিম রক্ষণশীল না প্রগতিবাদী, হিন্দুত্বপন্থী না মানবতাবাদী এই জিজ্ঞাসা অধিকাংশ সময়ে আমাদের চিন্তা দখল করে থাকে। বিশেষ করে হালের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সূত্রে আমরা অনেকেই বঙ্কিমরচনার সাহিত্যমূল্য সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত। অবশ্য এই সমস্ত জিজ্ঞাসার ও ‘সেকুলার’ দ্বিধার সদুত্তর পাওয়ার জন্য যতটা মন দিয়ে আমাদের বঙ্কিম পড়া উচিত ততটা মন দিয়ে আমরা বঙ্কিমের লেখা পড়ি না।

Advertisement
বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৪

বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাপত্র নিয়ে আমরা বিতর্কপরায়ণ। বঙ্কিম রক্ষণশীল না প্রগতিবাদী, হিন্দুত্বপন্থী না মানবতাবাদী এই জিজ্ঞাসা অধিকাংশ সময়ে আমাদের চিন্তা দখল করে থাকে। বিশেষ করে হালের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সূত্রে আমরা অনেকেই বঙ্কিমরচনার সাহিত্যমূল্য সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত। অবশ্য এই সমস্ত জিজ্ঞাসার ও ‘সেকুলার’ দ্বিধার সদুত্তর পাওয়ার জন্য যতটা মন দিয়ে আমাদের বঙ্কিম পড়া উচিত ততটা মন দিয়ে আমরা বঙ্কিমের লেখা পড়ি না। শুধু আম-পাঠকের কথাই বা বলি কেন, বঙ্কিমের রচনা সম্পাদনা করেছেন অথচ বঙ্কিমের অনেক লেখা পড়েননি এমন ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তির নজিরও বঙ্গসংস্কৃতিতে আছে। গভীর ভাবে বিতর্ক করার ও বঙ্কিমকে বোঝার অদ্বিতীয় উপায় বঙ্কিমের লেখা মন দিয়ে পড়া। বিবেকানন্দ জীবনের শেষ পর্বে যুবকদের বঙ্কিমের লেখা মন দিয়ে পড়তে বলতেন। এর পেছনে বিবেকানন্দের কোন মন কাজ করছিল তা বোঝার জন্যও বঙ্কিম পড়ার কাজটা আবার শুরু করা দরকার। খারিজ বা গ্রহণ যাই করি না কেন পড়াটায় যেন ফাঁক না থাকে। ফাঁক থাকলে ‘খারিজ’ বা ‘গ্রহণ’ দুই-ই ‘অসততা’ বলে বিবেচিত হতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সম্প্রতি খণ্ডে খণ্ডে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাবলি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন। বাঙালি পাঠকের হাতে সুসম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলি তুলে দেওয়াই তাঁদের উদ্দেশ্য। প্রকাশিত দুটি খণ্ডে রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের যাবতীয় উপন্যাস। বঙ্কিমের রচনায় একই বানানের নানা রূপ বজায় রেখে, রচনাগুলির পত্রিকাপাঠ ও সংস্করণ ভেদ মিলিয়ে দেখে প্রাজ্ঞ সম্পাদকমণ্ডলী তাঁদের পাঠ নির্মাণ করেছেন। মুখ্য উপদেষ্টা অধ্যাপক অলোক রায় বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত খণ্ডগুলির ভূমিকা রচনা করেছেন। গ্রন্থ শেষে বঙ্কিমজীবনের সালওয়ারি ঘটনাপঞ্জি দেওয়া হয়েছে, রয়েছে রচনাগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয়। প্রচলিত বাজারজাত বঙ্কিমচন্দ্র রচনাবলির চাইতে আকাদেমির এই প্রকাশনা গুণমানে উন্নত সন্দেহ নেই।

Advertisement

বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাকে সুসম্পাদিত চেহারায় এর আগে প্রকাশ করেছিল অপর এক সারস্বত প্রতিষ্ঠান— বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। স্বাধীনতার আগে উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানে ‘সাংস্কৃতিক’ জাতীয়তাবাদের ধারাটি ছিল প্রবল। ‘দ্য বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচর’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে, উমেশচন্দ্র বটব্যাল ও রাজনারায়ণ বসুর উদ্যোগ-উদ্দীপনায় পরের বছরে প্রতিষ্ঠানের বাংলা নাম হল ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’— কাজকর্মের ভাষাও ইংরেজি থেকে বাংলা হয়ে উঠল। প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যের নানা পুথির গ্রন্থরূপ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করল পরিষৎ, পাশাপাশি বেছে বেছে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক পর্বের ‘ধ্রুপদী’ গ্রন্থগুলি প্রকাশের পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হল। বঙ্কিমের রচনার পরিষৎ সংস্করণ এই সূত্রেই প্রকাশিত হয়। সেই কর্মকাণ্ডের প্রধান দুই উদ্যোক্তা ছিলেন সজনীকান্ত দাস ও ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক বাঙালি কবিদের প্রতি খড়্গহস্ত ছিলেন— নজরুল, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসুর পদ্য তাঁর প্যারোডির বিষয়, তীব্র কৌতুকের শিকার। রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিকদের প্রতি বিদ্রূপপরায়ণ হলেও সজনীকান্ত ও তাঁর সহযোগীরা ‘ধ্রুপদী’ বাংলা সাহিত্যের রসিক পাঠক ছিলেন। যথাযথ চেহারায় উনিশ শতকের রচনাগুলিকে বিশ শতকের পাঠকের কাছে প্রকাশ করা ছিল তাঁদের অন্যতম ব্রত। বিশেষ করে বঙ্কিমের রচনার প্রতি তাঁদের সানুরাগ মনোযোগ ছিল। এই অনুরাগের পিছনে সজনীকান্তের ‘হিন্দুমন’ ক্রিয়াশীল ছিল বলেই মনে হয়, তবে তথ্য সংগ্রহে তিনি ছিলেন অনলস। প্রসঙ্গত মনে পড়বে বঙ্কিমের জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত ‘শনিবারের চিঠি’র বিশেষ ‘বঙ্কিম সংখ্যা’-র (আষাঢ় ১৩৪৫) কথা। অত্যন্ত তথ্যবহুল এই সংখ্যাটি হালের ছোট পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা উৎপাদনকারী সম্পাদকদের সুশিক্ষিত করতে পারে, শেখাতে পারে কী ভাবে বিশেষ সংখ্যা নির্মাণ করতে হয়। সজনীকান্ত ও ব্রজেন্দ্রনাথ সাহিত্য পরিষৎ থেকে বঙ্কিমের রচনাগুলি একে একে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন। উপন্যাস ও অপরাপর রচনা সম্পাদনার ক্ষেত্রে তাঁরা একটি সুনির্দিষ্ট মডেল অনুসরণ করতেন। গোড়ার ভূমিকায় উপন্যাস সম্পর্কে ‘যাবতীয় জ্ঞাতব্য তথ্য’ প্রদান করা হত। উপন্যাসটি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হলে কোথায় কবে প্রকাশিত হয় সে তথ্য থাকত, বঙ্কিমের জীবৎকালে উপন্যাসের ক’টি সংস্করণ হয় কালানুক্রমিকতায় সেই প্রকাশকালের তথ্য প্রদান করতেন, বঙ্কিমের সমকালে উপন্যাস পাঠের প্রতিক্রিয়া কী ছিল তা উদ্ধৃত করতেন, এ ছাড়াও পরিশিষ্টে থাকত উপন্যাসের নানা সংস্করণের পাঠভেদ। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে দুই সম্পাদক নিবন্ধ রচনা করাতেন। যেমন রাজসিংহ উপন্যাসের পরিষৎ সংস্করণে ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের একটি নিবন্ধ ছিল। এখনও পর্যন্ত বাঙালি গবেষকদের কাছে বঙ্কিমপাঠের জন্য ব্রজেন্দ্রনাথ-সজনীকান্ত সংস্করণই নির্ভরযোগ্য। সাহিত্য পরিষদের কর্তৃপক্ষ চাইলে এই টুকরো সুসম্পাদিত গ্রন্থগুলির উপর নির্ভর করে খণ্ডে খণ্ডে বঙ্কিম রচনাবলি প্রকাশ করতে পারতেন। তবে পাঠকদের চাহিদার সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সামর্থ সবসময় মেলে না।

অবশ্য সজনীকান্ত-ব্রজেন্দ্রনাথের সম্পাদনাতেও কিছু ফাঁক ছিল। যে কোনও গবেষণাকার্যেই সীমাবদ্ধতা অনিবার্য, সজনীকান্ত-ব্রজেন্দ্রনাথের বঙ্কিম সম্পাদনাও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রয়াত বঙ্কিম-বিশেষজ্ঞ মৃদুলকান্তি বসু ব্রজেন্দ্রনাথ-সজনীকান্তের সেই ফাঁক পূর্ণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কোনও প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর না করে তিনি নিজের উদ্যোগে সহযোগী রেখে অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মাণ করছিলেন বঙ্কিমের রচনার নির্ভরযোগ্য পাঠ ও পাঠভেদ। বাঙালির খুবই দুর্ভাগ্য মৃদুলকান্তি বসুর প্রয়াণে সেই কাজ অসমাপ্ত থেকে গেল। তাঁর কাজ প্রকাশিত হল না। প্রতিষ্ঠানের বিপরীতেই অনেক সময় অভিমানী গবেষক একা কাজ করে যান— বঙ্কিমপ্রেমী মৃদুলকান্তি বসু ছিলেন তেমনই একজন মানুষ।

(১৮৩৮-১৮৯৪)

যাই হোক অপ্রাপ্তির তালিকা নির্মাণ করে লাভ নেই। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির এই দুই খণ্ড বাঙালি পাঠকদের আদর লাভ করবে বলেই মনে হয়। বঙ্কিমের উপন্যাসের বর্ণময়তার তুলনা নেই। সমকালে যতই তারকনাথ-ইন্দ্রনাথ উপন্যাস প্রণেতা বঙ্কিমের প্রতি বিরূপ হোন না কেন, কিশোর রবীন্দ্রনাথ থেকে নাটকের চরিত্র হেমাঙ্গিনী বঙ্কিমের নভেলের গোগ্রাসী পাঠক। বঙ্কিমের সাহিত্য কেবল ‘স্বভাব’কেই প্রকাশ করে না, ‘স্বভাবাতিরিক্ত’ যে কল্পনা তা বঙ্কিমের সাহিত্যের সামগ্রী। এই কল্পনার চালচিত্রেই তো বঙ্কিম তাঁর ‘আদর্শ’কে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত— পরিবার, সমাজ ও স্বদেশের আদর্শায়ন ঘটে তাঁর লেখায়। আবার অক্ষয়চন্দ্র সরকার তো বঙ্কিমকে কপালকুণ্ডলা-র কবি হিসেবেই চিনেছিলেন। পিতা গঙ্গাচরণ তখন বাংলা বই বাজারে এলেই কিনতেন। কপালকুণ্ডলা-র রস পিতা-পুত্র লোফালুফি করে উপভোগ করতেন। বঙ্কিমের নভেলে পথ হারানোর সেই সংস্কৃতি কি কেবল উনিশ শতকের ইতিহাস, নাকি এ কালের সাহিত্যের বাজারেও তার আদর হবে? হালের পাঠকের হাতে সুমুদ্রিত বঙ্কিমী নভেল পড়লে এই প্রশ্নের সদুত্তর মিলবে।

গবেষক পাঠক অবশ্য অপেক্ষা করছেন পরবর্তী খণ্ডের জন্য। শুধু বঙ্কিমের লেখা নয় বঙ্কিমের রচনার নানা পাঠ, পাঠান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্যের সমবায়ে প্রাজ্ঞ সম্পাদকেরা আশা করা যায় একটি খণ্ড নির্মাণ করবেন। সেই খণ্ড হাতে এলে তাঁদের বঙ্কিমভোজ পরিপূর্ণ হবে। সজনীকান্ত, ব্রজেন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ চৌধুরী, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য বঙ্কিমপাঠের ক্ষেত্রে নানা প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করেছেন। তবু তথ্যের ফাঁক তো ভরাট হয়নি। সেই ফাঁকগুলি আশা করা যায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সম্পাদকেরা ভবিষ্যতে ভরিয়ে দেবেন।

আরও পড়ুন
Advertisement