পুস্তক পরিচয় ৩

বিতর্কটাই ফের উস্কে দিলেন

১৯৬১-তে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে তৎপর হয়ে উঠলেন, সবচেয়ে বড় বাধা এল পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে। শাসকপক্ষের মনে হল, কবির শতবর্ষ পালন আসলে অবিভক্ত বাংলার আবহমান সংস্কৃতির আবাহন, রীতিমতো ভারতঘেঁষাও। এই বাধাদান পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিকে জাতিগত ভাবে আত্মস্বাতন্ত্র্যের লড়াইয়ে আরও বেশি করে এগিয়ে দিল।

Advertisement
শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
দ্য ব্লিডিং লোটাস/ নোশনস অব নেশন ইন বাংলাদেশি সিনেমা, জন উড। পালিম্পসেস্ট, ২৫০.০০

দ্য ব্লিডিং লোটাস/ নোশনস অব নেশন ইন বাংলাদেশি সিনেমা, জন উড। পালিম্পসেস্ট, ২৫০.০০

১৯৬১-তে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে তৎপর হয়ে উঠলেন, সবচেয়ে বড় বাধা এল পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে। শাসকপক্ষের মনে হল, কবির শতবর্ষ পালন আসলে অবিভক্ত বাংলার আবহমান সংস্কৃতির আবাহন, রীতিমতো ভারতঘেঁষাও। এই বাধাদান পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিকে জাতিগত ভাবে আত্মস্বাতন্ত্র্যের লড়াইয়ে আরও বেশি করে এগিয়ে দিল।

ষাটের দশকের প্রথম পর্বেই আওয়ামি লিগকে পুনর্বিন্যস্ত করে শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার করছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যলক্ষ্মী বা অর্থনৈতিক সুফলকে কাজে লাগানো হচ্ছিল কেবলমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে, যেন পূর্বাঞ্চলটা আর্থিক আমদানির কেন্দ্র, তেমন ভাবেই সরকার চালনা করছিল পাকিস্তানের শাসকপক্ষ। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে ধীরে ধীরে চারিয়ে যাচ্ছিল এমন এক বোধ যে, ইংরেজ চলে যাওয়ার পরও ফের দ্বিতীয় উপনিবেশের প্রজা যেন তাঁরা।

Advertisement

না, বাংলাদেশ নিয়ে কোনও ইতিহাসের বই নয়, বাংলাদেশি সিনেমা নিয়ে লিখতে-লিখতে ইতিহাসের ভিতর ঢুকে পড়েছেন জন উড। তাঁর দ্য ব্লিডিং লোটাস আদতে ফিল্মের হাত ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে জাতি গঠনের রূপরেখা। মূল শিরোনামের তলায় দ্বিতীয় একটি শিরোনামও আছে বইটির: নোশনস অব নেশন ইন বাংলাদেশি সিনেমা।

সিনেমার সাংবাদিকরা, বিশেষত পাণ্ডিত্যাভিমানী ফিল্ম আলোচকেরা বড় বেশি বাস্তববাদের তত্ত্ব খোঁজেন সিনেমায়। কতটা বাস্তব বুনব, এমন ভাবনা থেকে তো কোনও চলচ্চিত্রকারের ছবির কল্পনা তৈরি হয় না। পরিচালকের দৃশ্যশ্রাব্যের ভাষা ও কল্পনাকে ইতিহাস যেমন নিজের কাঠামোয় সাজাতে চায়, তেমনই চলচ্চিত্রকারের প্রকাশভঙ্গিও ইতিহাসের কাঠামোকে শিল্পের প্রকরণে পেশ করতে চায়। যে কোনও সৎ ছবি-করিয়েই প্রায় রাজা বিক্রমাদিত্যের মতো, ইতিহাস তাঁর ঘাড়ে যেন বুড়ো বেতাল। ইতিহাস যখন শিল্পীর ঘাড়ে চাপে, বা যখন শিল্পীর ঘাড় ইতিহাস বইবার মতো শক্ত, সেখান থেকেই সৃষ্টির নতুন অভিযান আরও নতুনতর অভিযানের দিকে এগোতে থাকে।

জন উড বাংলাদেশি সিনেমার সেই শিল্পিত ঐতিহাসিক অভিযানটিকেই গোটা বই জুড়ে সন্ধান করে গিয়েছেন, স্বভাবতই বাংলাদেশের বাঙালির জাতিসত্তার হাল-হদিশ উঠে এসেছে বইটিতে, সঙ্গে তর্কও। বইটির মুখবন্ধে তা খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন পল্লব ভট্টাচার্য, উড সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে দেশ-এরও স্বরূপ সন্ধান করেছেন, বহু জাতি-ধর্মের অবস্থান কোন ধরনের জাতীয়তা তৈরি করেছে বাংলাদেশের; যে আদর্শের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ ঘটেছিল, তা কোন ধরনের জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে— বাঙালি জাতীয়তাবাদ, না বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ?

জহির রায়হান, আলমগীর কবীর, সুভাষ দত্ত, শেখ নিয়ামত আলি ও মসিউদ্দিন শাকের, হারুনুর রশিদ, খান আতাউর রহমান, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, হুমায়ুন আহমেদ, শামীম আখতার-এর মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তো বটেই, আশির দশকের মধ্যপর্বে বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের তিন পুরোধা তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলাম ও তানভীর মোকাম্মেল অবিরত যে ধরনের ছবি তৈরি করে গিয়েছেন, তাতে বাঙালি জাতিসত্তারই কথা উঠে এসেছে বারবার। তানভীর তো তাঁর একটি প্রবন্ধে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন: ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনও আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা।’ (‘বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের চেতনার বিকাশ প্রসঙ্গে’) জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকাল থেকে পুরনো মুসলিম লিগের ধাঁচে বাঙালি জাতীয়তাকে সাম্প্রদায়িকতা মিশিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তা করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সিনেমার ভিতর দিয়ে সেই বিতর্কটাকেই ফের উস্কে দিলেন জন উড।

‘ভেরি ওরিজিনাল ওয়ার্ক ইনটারপ্রেটিং দ্য স্টোরি অব আ নেশনস বার্থ অ্যাজ টোল্ড থ্রু সিনেমা।’ বইটি সম্পর্কে পিছনের প্রচ্ছদে অনতিদীর্ঘ একটি অনুচ্ছেদে মন্তব্য করেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বাংলাদেশ ও তার সিনেমা নিয়ে এ ধরনের কাজ বাংলায় অনেক আগেই শুরু হয়েছে, এখনও হচ্ছে, কিন্তু অ-বাংলাভাষী পাঠকের জন্য সম্ভবত এইটিই প্রথম।

আরও পড়ুন
Advertisement