পুস্তক পরিচয় ১

বেছে নিয়েছিলেন তাঁর দেশ

সাধারণত আত্মকথার নামে স্পষ্টতা থাকে না। এই বই হাতে নিয়েও মনে হয়েছিল অস্পষ্ট, আলঙ্কারিক একটি নাম। পড়তে পড়তে উল্টো উপলব্ধিটা হল।

Advertisement
সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
আনট্র্যাঙ্কুইল রিকালেকশনস/ দ্য ইয়ার্স অব ফুলফিলমেন্ট, রহমান সোবহান। সেজ, ৪৫০.০০

আনট্র্যাঙ্কুইল রিকালেকশনস/ দ্য ইয়ার্স অব ফুলফিলমেন্ট, রহমান সোবহান। সেজ, ৪৫০.০০

সাধারণত আত্মকথার নামে স্পষ্টতা থাকে না। এই বই হাতে নিয়েও মনে হয়েছিল অস্পষ্ট, আলঙ্কারিক একটি নাম। পড়তে পড়তে উল্টো উপলব্ধিটা হল। কী এক অশান্ত আবহ যে রহমান সোবহানের আত্মপরিক্রমার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে, বলার নয়! একটি কর্মব্যস্ত জীবন ও পর্যবেক্ষণশীল মনের সৌজন্যে বাংলা ও বিশ্বের যে অতি অশান্ত চিত্রপট ধরে হেঁটে ফেললাম, তার অভিঘাত যেন হজম হতে চায় না। অশান্ত সময়ের এত শান্ত বিবরণও কি আমরা সচরাচর পড়ি? স্থিরতা, ধীরতা, এক রকমের নির্বিকারতা দিয়ে মোড়া এই অশান্ত সময়ের বিবরণ।

উপমহাদেশের তিনটি দেশেরই উত্তরাধিকার এই অর্থনীতিবিদ তথা পাবলিক ইনটেলেকচুয়ােলর মধ্যে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তিন দেশেই বসবাস করেছেন, প্রথম দুই দেশে ছাত্রজীবন কেটেছে, বাংলাদেশে পরবর্তী জীবন। কেমব্রিজ-এও কাটিয়েছেন অনেকটা সময়। পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ক্রমবিবর্তিত রাজনীতিতে যাঁদের আগ্রহ, তাঁরা খুঁজবেন এই বই। উপমহাদেশীয় অর্থনীতিবিদের চোখে উত্তর-ঔপনিবেশিক তৃতীয় বিশ্বে যাঁদের আগ্রহ, তাঁরাও। নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘দুই পাকিস্তানি অর্থনীতি’র বেত্তা হিসেবে। আক্ষরিক অর্থে দুই পাকিস্তানেই অর্থনীতির চর্চা করেছেন তিনি। দুই পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছেন। বাম দক্ষিণ দুই মহলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক। তার জন্য তাঁকে অসুবিধেও ভোগ করতে হয়েছে, যার ইঙ্গিত আছে বঙ্গবন্ধু মুজিবের সঙ্গে তাঁর আদানপ্রদানের বিবরণে।

Advertisement

যে প্রেক্ষাপটের কথা বলা হয়েছে এখানে, তার অনেক ইতিহাস ও কাহিনি আমাদের পড়া ও জানা। কিন্তু সেই সব ইতিহাস ও কাহিনির প্রায় কোনওটাই ‘রাজনীতি-ঊর্ধ্ব’ অবস্থান থেকে লেখা নয়, ‘নিরপেক্ষতা’ বস্তুটা সম্ভব কি না জানা নেই বলে সেটা না-হয় বাদই দিলাম। এমন আলেখ্য কি আমরা একটিও পড়েছি যাতে পাকিস্তান-প্রভাবিত মুসলিম লিগ রাজনীতি, সোহরাওয়ার্দি-মুজিবের আওয়ামি লিগ রাজনীতি, কিংবা মওলানা ভাসানির বাম রাজনীতি, সবেরই দুর্বলতাগুলি পাশাপাশি জায়গা পেয়েছে? অসংখ্য ঘটনার বিবরণ-সং‌বলিত বইয়ে কোনও গভীর বিশ্লেষণ খুঁজলে ব্যর্থ হতে হবে, কিন্তু ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রতিটি রাজনীতি-ধারার সমস্যা বেশ প্রকট হয়ে ওঠে। তার থেকে একটা সংকট পীড়া দিতেও শুরু করে। লেখক তাঁর কাহিনির মধ্যে দিয়ে একটা ক্লাইম্যাক্স তৈরি করেছেন বটে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্লাইম্যাক্স, দীর্ঘ জাতীয় আইডেন্টিটি সন্ধানের গন্তব্যে পৌঁছনোর ক্লাইম্যাক্স, বইয়ের সাব-টাইটল দিয়েছেন ‘দ্য ইয়ার্স অব ফুলফিলমেন্ট’। কিন্তু আমরা ভালই জানি, আজ আর ১৯৭১-কে কেবল ‘ফুলফিলমেন্ট’-এর গৌরবে সীমিত রাখা যাবে না। যে সব ভয়ানক সংকটের কাঁটা সে দিন গৌরবের পাতলা আস্তরণের নীচে ফুটে ছিল, সেগুলোর কথা ভাবতেই হবে। লেখক সচেতন ভাবে সে দিকে আলোকপাত করতে না চাইলেও তাঁর বর্ণিত ’৭১-পূর্ববর্তী রাজনীতির অন্তহীন দুর্বলতার মধ্যে লুকিয়ে আছে ’৭১-পরবর্তী কাঁটাগুলির বীজ এবং অঙ্কুর।

কেন এত সহজ আক্রমণের সুযোগ করে দিলেন রহমান সোবহান, কেন এমন সমালোচনা-যোগ্য একটি সাব-টাইট্ল রাখলেন? কীসের ‘ফুলফিলমেন্ট’? যখন পদে পদে এত সংঘর্ষ, ভোটের তাগিদে এত কমপ্রোমাইজ। মধ্য-পঞ্চাশের দশকে মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের বিধ্বংসী জয়ের পর বাংলা জাতীয়তাবাদের জোয়ারের মধ্যে কট্টর ইসলামিপনার সঙ্গে ভোট-রাজনীতির কত গা-ঘেঁষাঘেঁষি। উল্টো কামড় তো খাওয়ারই কথা ছিল সেই জাতীয়তাবাদের। মওলানা ভাসানির ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টির বাম রাজনীতিও কী ভাবে গণতান্ত্রিক জোটকে পিছন থেকে আঘাত হেনেছে, আয়ুব খান তাদের জন্য কত সহজে মার্শাল ল প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন: লেখকের নানা অভিজ্ঞতার মধ্যেই তো ‘ফুলফিলমেন্ট’-এর বিপরীত বক্তব্যও লুকিয়ে আছে। তা হলে?

নিজের কথা আর দেশের কথা যেখানে মিশে যায়, সেখানে প্রশ্নটির একটা অন্য উত্তর থাকতে পারে। এ হয়তো তাঁর নিজেরই ফুলফিলমেন্ট-এর কাহিনি। তাঁর সামনে যে কোনও দেশের নাগরিক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, ব্রিটেন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও যে তিনি আজ বাংলাদেশি, সে তাঁর নিজের বেছে নেওয়া আইডেন্টিটি। করাচিতে থাকতেন বাবা। কলকাতায় ছোটবেলা। দার্জিলিং ও লাহৌরে স্কুলজীবন। কেমব্রিজ থেকে ফিরে আসার সময় সব পথই ছিল খোলা। তবু তিনি ঢাকায় এলেন, ১৯৫৬ সালে, যে ঢাকায় তখনও তিনি এক মাসও কাটাননি। এই স্বহস্তকৃত ‘স্বদেশ’ নির্বাচনের পিছনে যে ভাবনা, বাংলাদেশ গঠনের ফলে কি তারই ‘ফুলফিলমেন্ট’ হল? আইডেন্টিটির ‘সম্পূর্ণতা’য় পৌঁছনো গেল?

স্বাধীন বাংলাদেশে রহমান সোবহান শেখ মুজিবের চার-সদস্যযুক্ত প্ল্যানিং কমিশনের অন্যতম সদস্য হন। লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক পথে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চালনা করা। বলা আজ বাহুল্যেরও বেশি যে সে লক্ষ্য পূর্ণ হয়নি। আরও কতকগুলি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ। রাষ্ট্রপুঞ্জে নতুন দেশের প্রতিনিধি হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক কর্মযজ্ঞের একটা চেহারা দেখেছিলেন, তার বেশ একটি সংক্ষিপ্ত সিনিক্যাল বর্ণনা আছে এখানে। ‘দুই পাকিস্তানের অর্থনীতিকের’ ভাবনার কেন্দ্রে থেকেছে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক আদানপ্রদানের বিষয়টিও। কিন্তু একের পর এক রাজনৈতিক অস্থিরতার পর্বে পর্বে তিনি কী ভাবে নিজের স্থিরতা বজায় রেখে গেলেন, এই বই সেই প্রশ্নও উশকে দেবেই।

মজার ব্যাপার, বড় ইতিহাসের দিক দিয়ে ভাবলে যে স্থিরতা এই বইয়ের প্রধান সম্পদ, ছোট ইতিহাস অর্থাৎ ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার দিক দিয়ে ভাবলে সেই স্থিরতাই বইটির প্রধান দুর্বলতা। বিভিন্ন বৃহত্তর রাজনীতির মধ্যে তাঁর নিজস্ব রাজনীতির গতিরেখাটি তিনি অস্পষ্টই রেখে দিলেন শেষ পর্যন্ত, পাঠককে বঞ্চিত করে।

আরও পড়ুন
Advertisement