পুস্তক পরিচয় ১

বাঙালির হেঁশেলের বিবর্তন

আমার মতো ভোজনরসিকরা এই বইয়ের নাম দেখলেই লাফিয়ে উঠবেন, তাই প্রথমেই তাঁদের সাবধান করে দেওয়া ভাল, এ কোনও জিভে জল আনার মতো বই নয়, ইতিহাসের রীতিমতো রাশভারী গ্রন্থ। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতোই উৎসা রায়ও ইতিহাসবিদদের জন্যই বই লিখেছেন।

Advertisement
জহর সরকার
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
কালিনারি কালচার ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া: আ কসমোপলিটান প্ল্যাটার অ্যান্ড দ্য মিডল ক্লাস, উৎসা রায়। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৬৯৫.০০

কালিনারি কালচার ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া: আ কসমোপলিটান প্ল্যাটার অ্যান্ড দ্য মিডল ক্লাস, উৎসা রায়। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৬৯৫.০০

আমার মতো ভোজনরসিকরা এই বইয়ের নাম দেখলেই লাফিয়ে উঠবেন, তাই প্রথমেই তাঁদের সাবধান করে দেওয়া ভাল, এ কোনও জিভে জল আনার মতো বই নয়, ইতিহাসের রীতিমতো রাশভারী গ্রন্থ। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতোই উৎসা রায়ও ইতিহাসবিদদের জন্যই বই লিখেছেন। প্রচুর গবেষণা করেছেন, মন দিয়ে সে-সব সন্নিবেশ করেছেন বইটিতে। তাঁর প্রত্যাশা, পাঠকও একমনে এ গ্রন্থ পাঠ করবেন। শিরোনামে ‘ঔপনিবেশিক ভারত’-এর কথা বলা আছে বটে, কিন্তু বইটি প্রধানত ‘ঔপনিবেশিক’ বাংলা, এবং তার মধ্যেও বিশেষত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত হিন্দু ভদ্রলোক বিষয়েই। তবে সেটাই পাঠকের পরিপাকশক্তির পক্ষে যথেষ্ট। তা ছাড়া, ‘ভারতীয় খাবার’ বলে সত্যিই কিছু আছে কি না জানি না, এক যদি না কেউ পঞ্জাবি বাটার চিকেনের সঙ্গে কেরলের আপ্পম কিংবা উত্তর ভারতের রবার-প্রতিম পনিরের সঙ্গে বাঙালির মাছকে মিলিয়ে ভাবতে রাজি থাকেন।

লেখক প্রভূত পাণ্ডিত্য সহকারে ঔপনিবেশিক বাংলায় ‘বিদেশি খাবার’-এর খোঁজ করেছেন, তবে রান্নাঘরের বিবর্তনকে তিনি স্থাপন করেছেন মধ্যবিত্তের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষিতে, এবং মাঝে মাঝেই তাঁর আলোচনায় এই বিষয়টি ফিরে এসেছে, তার সঙ্গে এসেছে লিঙ্গ, পরিসর, উদ্দেশ্য এবং রসনার ঔপনিবেশিক আধিপত্যের প্রশ্ন। অনেক পাঠকই হয়তো জানেন না, আলু, টমাটো, কাঁচালঙ্কা, পেঁপে এবং ভেন্ডি বা ঢেঁড়সের মতো আমাদের একেবারে নিত্যভক্ষ্য আনাজপাতিগুলি এসেছে আমেরিকা থেকে, তা-ও গত দু’চারশো বছরের মধ্যে। উৎসা স্মরণ করেছেন, সাহেবরা বাংলায় স্বদেশি মুলো, লাউ, বেগুন বা শশার একঘেয়েমি কাটাতে গাজর, কড়াইশুঁটি, পিচ, কুল, চেরি, এপ্রিকট বা খোবানি, র‌্যাস্পবেরি, গুজবেরি ইত্যাদি ‘সুদর্শন’ খাবারদাবার নিয়ে আসতে তৎপর হয়েছিল। বিশ শতকের প্রথম দিকের বাংলায় খাওয়াদাওয়ার দ্বান্দ্বিক বাস্তবের কিছু ছবিও আমরা দেখতে পাই— শিক্ষিত তরুণরা চা বিস্কুট পাউরুটির মতো নতুন ‘ঔপনিবেশিক’ খাবারের পরম ভক্ত হয়ে পড়েছে, আর মা-বাবারা তাতে মর্মাহত।

Advertisement

বাঙালি রান্নাকে বোঝার জন্য লেখক বাঙালি রান্না বিষয়ক বহু বই চর্চা করেছেন— ১৮৩১ সালের পাকরাজেশ্বর বা ১৮৫৮’র ব্যঞ্জনরত্নাকর থেকে শুরু করে গত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ বিষয়ে যত বই প্রকাশিত হয়েছে, সব। সেটা খুবই প্রশংসনীয় এবং সমীহ করার মতো কাজ, কারণ এগুলির মধ্যে অনেক বইই এখন দুষ্প্রাপ্য। তা ছাড়া, বহু ইংরেজি বই থেকে ভারতীয় রান্না সম্পর্কে নানা উদ্ধৃতি সংগ্রহ করেছেন, অনেক বিশিষ্ট মানুষের লেখা ও মন্তব্য থেকেও বহু মণিমুক্তো তুলেছেন। প্রসঙ্গত, দেখা যাচ্ছে, অনেকেই তাঁদের খাবারে সেই ছ’টি ধ্রুপদী রসাস্বাদই পছন্দ করতেন: মধুর অম্ল লবণ কটু কষায় তিক্ত।

বাঙালির রান্নাঘরে পেঁয়াজ, রসুন এবং নানান মশলার সঙ্গে মোগলাই মাংসের নানা পদ কী ভাবে ঢুকল, এ বই সেই প্রসঙ্গকে কেবল ছুঁয়ে গেছে, তবে ১৮৫৬ সালে নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ তাঁর বাবুর্চি বাহিনী সমেত লখনউ থেকে কলকাতায় আসার ফলে পাকপ্রণালীতে কী ধরনের বিপ্লব ঘটেছিল, গ্রন্থকারের কাছে সে বিষয়ে আর একটু বিশদ আলোচনার প্রত্যাশা ছিল। এটা দুঃখের কথা যে, কয়েক শতাব্দী পাশাপাশি থেকেও উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালি যে স্থানীয় মুসলমান খানাকে এড়িয়ে চলেছিলেন, শেষ পর্যন্ত সাহেবরা নিজেদের অজান্তেই তাঁদের সেই খাদ্যরসের রসিক করে তুলল। লেখক বাঙালি মুসলমানের কথা কিছুটা বলেছেন, প্রধানত এটা দেখানোর জন্য যে, গোমাংস ভক্ষণের প্রশ্নটি কী ভাবে একটা বৃহত্তর আর্থসামাজিক দ্বন্দ্বের থেকে নজর সরিয়ে দিয়েছিল। তবে, মাছভাতের আকর্ষণ কী ভাবে মুসলমান ও হিন্দু বাঙালিকে মিলিয়ে দিয়েছিল, সেটাও তিনি লিখতে ভোলেননি।

উৎসা আইরিশ স্টু, ফ্রেঞ্চ মাটন কাটলেট, ইংলিশ চপ এবং সুস্বাদু পুডিং, কাস্টার্ড আর জেলির কথা লিখেছেন, এমনকী সর্বত্র বিরাজমান ‘ইন্ডিয়ান কারি’র উৎসও সন্ধান করেছেন— যে বিষয় নিয়ে একটা আস্ত বই লেখা যায়। তিনি দেখিয়েছেন, ল্যাম্ব কারি, ডিমের কারি, গ্রিল্‌ড চিকেন, মাংসের কিমা এবং পাই-এর মতো ‘ফিরিঙ্গি’ খাবারগুলি কী ভাবে বাঙালি ভদ্রলোক-এর পাতে জায়গা করে নিল এবং কী ভাবে তাদের সঙ্গে এঁচোড়, মোচা, ইলিশ, পারশে কিংবা তেল-কইয়ের সম্পর্ক তৈরি হল। কলকাতা এখনও এই ইতিহাসের কিছু উত্তরাধিকার বহন করছে, যেমন চপ-কাটলেট, কিংবা (সত্যিকারের ভেটকি মাছ দিয়ে) ফিশ ফ্রাই, যে জিনিস ভারতের অন্যত্র, এমনকী খাস বিলেতেও খুঁজে পাওয়া কঠিন। লেখক বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের বড় ঘরের বাঙালি ভদ্রমহিলাদের ব্যক্তিগত লেখালিখি চর্চা করে দেখিয়েছেন, নিজেদের রন্ধনশৈলীর পাশাপাশি বিলিতি খানা বাড়িতে তৈরি করার দক্ষতা তাঁরা কী ভাবে রপ্ত করেছিলেন।

উৎসা রায় কিছু বিতর্ক নিয়ে ভাল আলোচনা করেছেন। যেমন, ‘ভাত বনাম রুটি’, কিংবা ‘মাইনে-করা পুরুষ পাচক বনাম প্রেমময়ী বউ’। বাড়িতে ঘি কিংবা পাউরুটি ঢোকানো বিধেয় কি না, সে ব্যাপারেও জাতপাত, ‘শুচিতা’ এবং জলচল-এর বিধান কী ভাবে প্রভাব ফেলেছে, এই বইয়ে সে কথা আলোচিত হয়েছে। বস্তুত, যে কোনও (জাতের) মানুষের হাতে যেহেতু ভাত খাওয়ার বিধান নেই, সেই কারণেই নানা রকম ছলচাতুরির আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল, যেমন ভাতের বদলে লুচি, কিংবা ভাত না বলে ‘প্রসাদ’ বলা। ‘স্বর্ণযুগের বাঙালি খাবার’ সম্পর্কে প্রচলিত কল্পনাবিলাসকে উৎসা সম্পূর্ণ ভুল বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, ঠিকই করেছেন, কারণ মধ্যযুগের বাংলার খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে আমরা যা কিছু জেনেছি, তার কোনওটাই এমন রোমান্টিক ধারণাকে সমর্থন করে না। গরম ভাতের পাহাড়ে খানিকটা ঘি ঢেলে তার পাশে ক’টা শাক, তরকারি, বেগুন, দু’চারটে বড়ি, এবং নুন, জিরে, হিং আর মেথি দিয়ে রান্না ট্যালটেলে ঝোলের মধ্যে ভেসে থাকা মাছের টুকরো— এই দিয়ে রন্ধনশৈলীর পদ্মা-গঙ্গায় তুফান তোলা সম্ভব নয়। নানা ধরনের মাছ খাওয়ার সামর্থ্য যাঁদের ছিল তাঁরা হয়তো তা থেকে রসনার তৃপ্তি সংগ্রহ করতে পারতেন, কিন্তু বেশির ভাগ বঙ্গসন্তানই সে সৌভাগ্যে বঞ্চিত ছিলেন। উৎসা দেখিয়েছেন, কিছু কাল আগে পর্যন্তও সমস্ত গ্রামের ভোজে কেবল নিরামিষ খাবারই দেওয়া হত। আর, কী হিন্দু কী মুসলমান— বাঙালির ঘরে মাংস খাওয়ার অভ্যাস অনেক পরে এসেছে।

উৎসা রায় তাঁর আলোচনাকে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে ভাগ করেছেন, যদিও সেগুলির মধ্যে নিশ্ছিদ্র সীমান্ত নেই, থাকার কথাও নয়। তিনি উদ্ধৃতির অনুপাত কিছুটা কমিয়ে নিজের বক্তব্য আর একটু বেশি লিখলে বোধহয় আরও ভাল হত। তবে এটা দেখে খুব ভাল লাগল যে, মঙ্গলকাব্য থেকে খাবারদাবার সম্পর্কে তিনি অনেক মালমশলা সংগ্রহ করেছেন। তপন রায়চৌধুরী, কুমকুম চট্টোপাধ্যায় এবং এই অধমের মতো কয়েক জন অনেক দিন ধরে ইতিহাসবিদদের উদ্দেশে বলে আসছি, মধ্যযুগের বাংলাকে বুঝতে হলে মঙ্গলকাব্য অপরিহার্য। উৎসা এ কথার সত্যতা প্রমাণ করেছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement