চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

বিকল্প রূপকল্পে জেগে ওঠে প্রতিবাদী চেতনা

সিমায় চলছে পাঁচ শিল্পীর সম্মেলক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ সিমা গ্যালারিতে এখন চলছে পাঁচ শিল্পীর যে সম্মেলক তার শিরোনাম : ‘এক্সপেরিমেন্টস: ফাইভ পোস্টমডার্ন এক্সপ্রেশনস ফ্রম বেঙ্গল’। ‘মডার্ন’ কথাটি অনেক সময় কালবাচক অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ‘পোস্টমডার্ন ’ কখনওই কালবাচক নয়। এটি একটি দর্শন, যা ইঙ্গিত দেয় সত্যের কোনও নির্দিষ্ট, নির্ধারিত রূপ নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০

সিমা গ্যালারিতে এখন চলছে পাঁচ শিল্পীর যে সম্মেলক তার শিরোনাম : ‘এক্সপেরিমেন্টস: ফাইভ পোস্টমডার্ন এক্সপ্রেশনস ফ্রম বেঙ্গল’। ‘মডার্ন’ কথাটি অনেক সময় কালবাচক অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ‘পোস্টমডার্ন ’ কখনওই কালবাচক নয়। এটি একটি দর্শন, যা ইঙ্গিত দেয় সত্যের কোনও নির্দিষ্ট, নির্ধারিত রূপ নেই। সত্যের আছে এক নিরন্তর হয়ে ওঠা। সমস্ত অভিধা-কেন্দ্রিকতার বাইরে এসে শিল্পীকে তাই প্রতিনিয়ত অপ্রচলিত আঙ্গিকে নিরীক্ষার পথে যেতে হয়। এই নিরীক্ষার মূল ভিত্তি ভাবনার বিস্তার। এর আঙ্গিক-পদ্ধতিকে অনেক সময় বলা হয় বিকল্প রূপকল্প। আমাদের দেশে পোস্ট-মডার্ন এসেছিল বিশ্বায়নের দ্বান্দ্বিক প্রতিক্রিয়ায়। তাই বিকল্প রূপকল্পের ভিতর অনেক সময়ই থাকে প্রতিবাদী-চেতনা। আলোচ্য প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন পাঁচজন শিল্পী : সুমিত্র বসাক, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, পীতাম্বর খান, সঙ্গীতা মাইতি ও কিংশুক সরকার। আঙ্গিক নিয়ে নিমগ্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সকলেরই কাজের বৈশিষ্ট্য।

Advertisement

আধুনিক ও আধুনিকতাবাদী শিল্পের যে আপাত-মহনীয়তা, তাকে সব সময়ই ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন সুমিত্র। নিম্নবর্গীয় জীবনে ব্যবহৃত নানা উপকরণ প্রথাবিরোধী রীতিতে ব্যবহার করে শ্লেষ ও কৌতুকের মধ্য দিয়ে বাস্তবের বিনষ্টিকে পরিহাস করতে চান শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী এই শিল্পী। সাঁটা-কাগজের মতো দ্বিমাত্রিক বর্ণিল উপস্থাপনাতেও নিষ্পিষ্ট জীবনের প্রতীকী ভাষ্য। অজস্র প্লাস্টিক খেলনা সাজিয়ে গড়েছেন ভিড়াক্রান্ত এক শহরের প্রতিমাকল্প। নাম দিয়েছেন ‘আমার দেশ’। ‘পক্ষীরূপী ধর্ম’ শীর্ষক ১২-টি অ্যাক্রিলিকের রচনার সমন্বয়ে গড়ে তোলা ছবিটিতে লৌকিক পুরাণকল্পের নানা অনুষঙ্গ কৌতুকদীপ্তভাবে ব্যবহার করেছেন। মোট ১৫-টি রচনার মধ্যে ইনস্টলেশনধর্মী কাজও রয়েছে।

শ্রেয়সী-র রচনার ভিত্তি লৌকিক মানবীচেতনা। সূচিশিল্পের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ মানবী যে সূক্ষ্ম রূপের বুনন করে আসছেন অনাদি কাল থেকে, সেই প্রকরণকে প্রজ্ঞাদীপ্তভাবে ব্যবহার করে এই শিল্পী নাগরিক রূপবোধকে প্রবহমান ঐতিহ্যে স্পন্দিত করে তুলেছেন এই প্রদর্শনীর ১২-টি রচনায়। ‘টোপোস্কেপ-১’ শীর্ষক রচনাটি উদাত্ত নীলিম নিসর্গের অসামান্য দৃষ্টান্ত। শাড়ির টুকরো সেঁটে অভিনব ডিজাইনে করা ‘দ্য ইনট্রুডার্স’ শীর্ষক রচনাটিতে শিল্পী যেন তাঁর নিজের পরিচিত আঙ্গিক-পদ্ধতিকেও অতিক্রম করে গেছেন। সুতোর কাজের সঙ্গে কালি-কলমের রেখার সমন্বয়ে করা ড্রয়িং-ধর্মী রচনাগুলিও সমৃদ্ধ অনুভবের ইঙ্গিতবাহী।

পপ বা পপুলার-এর ব্যতিক্রমী ব্যবহারের দৃষ্টান্ত রেখেছেন অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পী পীতাম্বর। এই শিল্পী লরি বা অন্যান্য যানবাহনের গায়ে যে অপরিশীলিত হাতের ছবি আঁকা থাকে, সেই রূপরীতিকে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর ছবিতে। সেই আঙ্গিকের অনুষঙ্গেই এই প্রদর্শনীর ছ’টি রচনায় টারপুলিন ও অ্যালুমিনিয়ম-পাতের উপর এঁকেছেন পথের অপরিশীলিত দৃশ্যের ছবি। বাস্তবের দৃশ্যের সঙ্গে সাঙ্কেতিকতাকে মিলিয়ে এক নতুন দৃশ্যদর্শন তৈরি করেছেন তিনি।

ছাপচিত্র নিয়ে ব্যতিক্রমী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই মাধ্যমের সম্ভাবনাকে অনেকটা প্রসারিত করার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রভারতী থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর-উত্তীর্ণ সঙ্গীতা। কেওনঝরে লোহার খনির পরিমণ্ডল এবং আদিবাসীদের জীবনচর্যা তাঁকে নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতির যে সচেতনতা দিয়েছে, তার প্রকৃষ্ট ব্যবহার করে তিনি যে আঙ্গিক নির্মাণ করেছেন তার অভিনবত্ব অসামান্য। এচিং এমবস পদ্ধতিতে করা সাতটি রচনার সমন্বয়ে সাদার উপর সাদায় করা কাজটির শিরোনাম ‘এ সেট্লমেন্ট টু ডিপেন দ্য ল্যান্ড’। অত্যন্ত সংবৃত এই রচনাটিতে তাঁর গভীর মননের পরিচয় রয়েছে।

বাস্তবের প্রবল ও পরিবৃত এই বিনষ্টিতে তাঁর সমস্ত ক্ষোভ উজাড় করে দিয়েছেন শান্তিনিকেতনের বিশিষ্ট শিল্পী কিংশুক। কাপড়ের উপর টেম্পারা-গ্রাসা মাধ্যমে আঁকা তাঁর পাঁচটি ছবির শিরোনাম ‘পাবলিক মুডস অ্যান্ড মাস মেলাঙ্কোলিয়া’। আজকের সামগ্রিক বাস্তবতাকে তীব্র কশাঘাত করেছেন। রক্তাক্ত শিশুটিকে কোলে নিয়ে পথের উপর বসে আছে অসহায় এক মা। এই দৃশ্যে ভাবালুতা বর্জিত যে তীব্রতা এনেছেন, তা খুব সহজ কাজ নয়। রাস্তার উপর একটি নগ্ন পুরুষকে দু’হাত বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানোর ব্যবস্থা করছে মাস্তানরা। এরকম আখ্যান-মূলক দৃশ্যের পাশাপাশি একই শিরোনামে তিনি যখন আঁকেন গহন কালোর সমতল বিন্যাসের চিত্রপট, তখন বোঝা যায় তাঁর আঙ্গিক-ভাবনা কত স্বতন্ত্র ও গভীর।

আরও পড়ুন
Advertisement