চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

প্রকৃতি থেকেই উঠে আসে আনন্দের বাতাবরণ

সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত দেবব্রত হাজরার একক দেখে এলেন মৃণাল ঘোষবিহঙ্গের আনন্দে ভরা বাগান। এই হল প্রদর্শনীর শিরোনাম। ‘দ্য গার্ডেন অব অ্যাভিয়ান ডিলাইটস’। এই শিরোনামে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অ্যাক্রিলিক, তেল ও জলরঙে আঁকা ৭০ টি ছবি নিয়ে একক প্রদর্শনী করলেন দেবব্রত হাজরা। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে তিনি পাশ্চাত্য চিত্রকলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেছেন যথাক্রমে ১৯৯৭ ও ২০০১ সালে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
শিল্পী: দেবব্রত হাজরা

শিল্পী: দেবব্রত হাজরা

বিহঙ্গের আনন্দে ভরা বাগান। এই হল প্রদর্শনীর শিরোনাম। ‘দ্য গার্ডেন অব অ্যাভিয়ান ডিলাইটস’। এই শিরোনামে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অ্যাক্রিলিক, তেল ও জলরঙে আঁকা ৭০ টি ছবি নিয়ে একক প্রদর্শনী করলেন দেবব্রত হাজরা। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে তিনি পাশ্চাত্য চিত্রকলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেছেন যথাক্রমে ১৯৯৭ ও ২০০১ সালে।

কলকাতায় ছবির পরিমণ্ডল এখন ভাল নেই। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত। শিল্পপতিদের বিনিয়োগ ক্রমেই বিলীন হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থলগ্নির পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। চিত্র-ভাস্করের সংগ্রাহকরা ক্রমেই হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন। ছবির বাজার খুবই নিষ্প্রভ। অনেকেই গতানুগতিক প্রদর্শনী করে যাচ্ছেন। অনেক শিল্পীই হতাশ। আয় না থাকলে কত দিন আর ছবি আঁকা চালিয়ে যাওয়া যাবে। ছবির বিষয় ও আঙ্গিকেও সেই হতাশার প্রকাশ ঘটছে। ললিত কলার প্রকাশভঙ্গিতে এখন দুটি প্রবণতার প্রাধান্য। পুরনো পথ ছেড়ে নতুন পথে চলতে চাওয়া শিল্পীরা কাজ করছেন কনসেপচুয়াল আর্টের নানা দিক নিয়ে। বিশ্বায়ন ও উত্তর-আধুনিকতার দ্বান্দ্বিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া থেকে গড়ে উঠেছিল যে রূপভাবনা ১৯৯০-এর পরবর্তী সময়ে তারই নানা দিক নিয়ে তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর একটি ধারায় আধুনিক ও আধুনিকতাবাদী রূপকল্পের প্রাধান্য। অনেক ক্ষেত্রেই বিগত দেড়শো বছরের চর্চিত আঙ্গিকের পুনরাবর্তন ও প্রসারণ। এরই মধ্যে কিছু উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গের সন্ধান পাওয়া যায়।

Advertisement

দেবব্রত হাজরার প্রদর্শনীটি সে দিক থেকে একটু অন্য রকম। পাখিদের নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। প্রকৃতি থেকে তুলে আনতে চেয়েছেন আনন্দের বাতাবরণ। শহরে কাক ছাড়া অন্য পাখিরা ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দূরতর কোনও গ্রাম বা অরণ্যে গেলে এখনও হয়তো নানা প্রজাতির পাখির সন্ধান মেলে। দেবব্রত সেই বনানীর পরিমণ্ডলেই বিচিত্র সব পাখির জীবন-স্পন্দনকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। খুবই বর্ণিল তাঁর ছবি। নানা আঙ্গিকে কাজ করেছেন। ‘কম্পোজিশন’ বা রূপবিন্যাসেরও বৈচিত্র আছে। এই বৈচিত্র বুঝতে কয়েকটি ছবির দিকে নিবিষ্ট দৃষ্টিপাত করতে পারি।

‘হোমওয়ার্ড অ্যাট ডাস্ক’ শীর্ষক ছবিটি ক্যানভাসের উপর কালি-কলমের রেখায় আঁকা। পশ্চাৎপটে বেশ কিছুটা শূন্য পরিসর ছেড়ে মধ্যবর্তী অঞ্চলে শিল্পী প্রতিমা সংস্থাপন করেছেন। তাঁর রেখায় চৈনিক ক্যালিগ্রাফির কিছু দূরতর বিচ্ছুরণ আছে। ছন্দোময়তা তাঁর আঙ্গিকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ছড়ানো কিছু পুষ্পিত বৃক্ষের আভাস। তার মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে বা ডালে বসে আছে কয়েকটি পাখি। ‘সাইলেন্স অব দ্য কিংফিশার’ ছবিটি একেবারেই বিপরীতধর্মী। সেই অন্ধকার ভেদ করে মধ্যবর্তী অঞ্চলে আলোর উদ্ভাসের মধ্যে অসংখ্য বৃক্ষের জটলা। মাঝখানে প্রক্ষিপ্ত উজ্জ্বল আলোতে বসে আছে একটি মাছরাঙা পাখি। ‘সিম্ফনি ইন রেড মেজর’ শীর্ষক তেলরঙের ক্যানভাসে প্রেক্ষাপট জুড়ে উজ্জ্বল লালের বিস্তার। মাঝখানে একটি তালগাছ। তাকে ঘিরে একটি লতার আবর্তন। সেই আবর্তনের মধ্যে উড়ছে দুটি পাখি। এরকম নানা বৈচিত্রময় আঙ্গিকে শিল্পী কাজ করেছেন।

তিনি তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র এক বাস্তব। এদিক থেকে প্রাচ্য-ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁর ছবির মিল। পাশ্চাত্য আধুনিকতায় প্রতিচ্ছায়াবাদী রূপরীতিতে শিল্পীর আত্মচেতনার যে উন্মীলন ঘটে, তার নানা রেশ তাঁর ছবিতে রয়েছে। তবু প্রতিচ্ছায়াবাদ বা উত্তর-প্রতিচ্ছায়াবাদ দৃশ্য-বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ পরিহার করতে পারেনি। প্রাচ্য-শিল্প, চিন জাপানের নিসর্গ রচনায়, বাস্তবতা থেকে উত্তরণ সহজেই পরিলক্ষিত হয়। মুঘল-শিল্পে অনেক পাখির রূপায়ণ আছে। সেখানেও দৃশ্য বাস্তবতার কিছু অনুষঙ্গ থেকে গেছে। রাজস্থানী বা পাহাড়ি অণুচিত্র সে দিক থেকে অনেক মুক্ত। অলৌকিকের বিভা তাঁরা আনতে পেরেছেন সহজেই। কোম্পানি স্কুলের পাখির ছবিতে দেখা যায় অনুপুঙ্খ-বাস্তবতার নিবিষ্ট প্রকাশ। নব্য-ভারতীয় ঘরানা সেই স্বাভাবিকতাকে আকাশের উদাত্ততার দিকে নিয়ে গেছে। অবনীন্দ্রনাথ বা নন্দলালের পাখির ছবিতে দেখা যায় সেই উজ্জীবনের আলো।

দেবব্রত নানা উৎসকে সমন্বিত করেছেন তাঁর ছবিতে। প্রাচ্য চেতনা সঞ্জাত অলৌকিক এক আলোয় আকাশকে ধরণীতে নিয়ে এসেছে তাঁর পাখিরা।

আরও পড়ুন
Advertisement