পুস্তক পরিচয় ২: বাংলাদেশের বই

পাঠকের চেতনার দিগন্ত প্রসারিত করে

সোনালী কাবিন শুধু বাংলাদেশের বৃহত্তর জনমানসের ও লোক-ঐতিহ্যের স্পর্শ-গন্ধ, নিসর্গের সবুজ দীপ্তিতে প্রাণময় নয়, দেশের মানুষের প্রেম-প্রীতি ও স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা এবং দেশ-আত্মাও নবীন মাত্রা নিয়ে উন্মোচিত হয়েছিল। এক জন কবির কাছে পাঠকের যে দাবি, তা তিনি অতি যত্নে, পরিশীলিত বোধে এবং গভীর এক প্রত্যয় নিয়ে ব্যক্ত করেন। সর্বদা আমরা এই চেতনারই সম্প্রসারণ প্রত্যক্ষ করি তাঁর কবিতায়। কবিতার সঙ্গেই তাঁর প্রধানত বসবাস।

Advertisement
আবুল হাসনাত
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০১
তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে। আল মাহমুদ। বই কারিগর, ১৩০.০০

তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে। আল মাহমুদ। বই কারিগর, ১৩০.০০

আল মাহমুদ বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি। তাঁর যে কোনও রচনা, কবিতা বা গদ্য, কবি-গুণান্বিত এবং শিল্পিত প্রকরণসমৃদ্ধ। তাঁর কবিতা পাঠকের চেতনার দিগন্তকে বিস্তৃত করে, কখনও আবেগেও স্পন্দিত হই। যদিও প্রবল ধর্মীয় বোধ, কবিতায় মুসলিম ঐতিহ্যের নানা প্রকাশ, শব্দ নির্বাচন, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ও মনোভঙ্গি এবং জীবনযাপনে ধর্মীয় বিষয়াবলির অধিক প্রাধান্য তাঁকে কিঞ্চিৎ বিতর্কিত করলেও মাতৃভাষার বলয়ের সমীকরণে তাঁর পংক্তি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়স্পন্দনের ধ্বনি হয়ে ওঠে। তিনি আদ্যোপান্ত বাংলা ভাষার কবি। কবিতা ছাড়া তাঁর দ্বিতীয় কোনও প্রেম নেই। প্রথম গ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩), তারপর কালের কলস (১৯৬৬)। সোনালী কাবিন (১৯৭৩) থেকে তাঁর মানসভুবন ভিন্ন মাত্রা পেয়ে যায়।

সোনালী কাবিন শুধু বাংলাদেশের বৃহত্তর জনমানসের ও লোক-ঐতিহ্যের স্পর্শ-গন্ধ, নিসর্গের সবুজ দীপ্তিতে প্রাণময় নয়, দেশের মানুষের প্রেম-প্রীতি ও স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা এবং দেশ-আত্মাও নবীন মাত্রা নিয়ে উন্মোচিত হয়েছিল। এক জন কবির কাছে পাঠকের যে দাবি, তা তিনি অতি যত্নে, পরিশীলিত বোধে এবং গভীর এক প্রত্যয় নিয়ে ব্যক্ত করেন। সর্বদা আমরা এই চেতনারই সম্প্রসারণ প্রত্যক্ষ করি তাঁর কবিতায়। কবিতার সঙ্গেই তাঁর প্রধানত বসবাস।

Advertisement

বর্তমানে তাঁর শরীর জর্জর; লোকচক্ষুর আড়ালেই সময় অতিবাহিত করেন। দৃষ্টি ক্ষীণ, তবু তিনি যখন এই শরীর নিয়ে অন্তঃপ্রেরণা বা অন্তর্মুখী চেতনার তাগিদে কবিতা লেখেন, পাঠকের জন্য তা সংবাদ হয়ে ওঠে।

ম্প্রতি হাতে এল আল মাহমুদ রচিত ক্ষীণকায় কাব্যগ্রন্থ তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে। নামকরণেই তাঁর চারিত্র্য প্রতিভাত। চিত্রকল্প, তাঁর শব্দ-নির্বাচন এবং কবিতার শৈলী আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দীর্ঘদিনের কবিতা-চর্চার মধ্যে কী তাঁর অন্বিষ্ট। কত তীক্ষ্ণ তাঁর সংবেদন; কত প্রবল ও মনোগ্রাহী তাঁর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি। প্রেম, প্রকৃতি ও আস্তিক্যবোধই এই কবিতাগ্রন্থের প্রধান বিষয়।

কবিতায় পরিপূর্ণ ভাবে নিমজ্জিত হয়েছিলেন সোনালি কাবিন-এর যুগে। এখনও তাঁর স্পন্দিত শব্দের চরণে দীপিত হয় ছন্দ, প্রেমের ভেলা ভাসিয়ে দেয় বিরহী-হৃদয়। এখনও কবির প্রেয়সী কবিতা ও দয়িতা-নারীর জন্য উন্মনা হয়ে ওঠে। গন্ধময় হয়ে প্রাণ পায় প্রকৃতি। পুষ্পিত অনুষঙ্গ জীবনকে করে তোলে অর্থময়।

বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে হাসান আজিজুল হক একক ভাবে যে সমৃদ্ধি এনেছেন, তা শুধু ঈর্ষণীয় নয়, তাঁর সৃজনে যে জীবনবোধ ও অঙ্গীকার উন্মোচিত হয়, তা নিশ্চিতই বাংলা সাহিত্যকে নবমাত্রায় সঞ্জীবিত করেছে। উভয় বঙ্গেই শ্রদ্ধার আসন অর্জন করেছেন তিনি। তাঁর ছোটগল্প কিংবা উপন্যাসে

আমরা যে-জীবনচেতনা প্রত্যক্ষ করি, তা সৃজনধর্মিতায় অনন্য এবং জীবনের নানা অনুষঙ্গ, কখনও জটিল, সূক্ষ্ম ও বহুমাত্রায় উঠে আসে। তাঁর রচিত দুটি উপন্যাস আগুনপাখি ও সাবিত্রী উপাখ্যানে জীবনের অতল স্পর্শের যে খোঁজ পাই, তা আমাদের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বিস্তৃত করে। ইদানীং তিনি দুটি খণ্ডে যে স্মৃতিকথা লিখেছেন, তা নানা দিক থেকে তাৎপর্যময় ও আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। তিনিই বোধ করি এমন এক লেখক, যাঁর অঙ্গীকারে মানুষের জীবনযন্ত্রণা এবং দুঃখকষ্ট নিপুণ বাস্তবতায় এবং কখনও-সখনও অতিবাস্তবতায় আমাদের জিজ্ঞাসার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর যৌবনকালে রচিত একটি উপন্যাস শামুক। কৈশোরক রচনা বলে এই উপন্যাসটি বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে ছিল। হাসান-গবেষক এক তরুণ সম্প্রতি পত্রিকা থেকে উদ্ধার করে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন। হাসান আজিজুল হকের ছোট একটি ভূমিকা আছে উপন্যাসে। শামুক রচিত হয় ১৯৫৭ সালে, আর রাজশাহির ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। হাসানের শক্তিমাত্রা তখন যে কত সম্ভাবনাময় ছিল এবং জীবনের নানা দিকের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের উন্মোচনও সেই সময় এক অঙ্গীকার নিয়ে ধরা পড়েছিল, তার চিহ্ন ধরা আছে শামুক-এ। হাসান উল্লেখ করেছেন, তিনি এ উপন্যাসটি লেখেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কারের জন্য। নির্বাচিত একশোটি উপন্যাসের চূড়ান্ত বাছাইয়ে সাতটির মধ্যে শামুক স্থান করে নিয়েছিল। পুরস্কার পান মতি নন্দী, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় ও পূর্ণেন্দু পত্রী। হাসান আজিজুল হক কথাসাহিত্যে যে গদ্য নির্মাণ করেন অতিযত্নে, তা শামুক উপন্যাসটিতে প্রস্তুতি প্রক্রিয়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। খুব বড় ক্যানভাস নেই বটে, তবে জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত এক কেরানির জীবন সংগ্রামের কথা আছে। তার স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা এবং জীবনবাস্তবতা প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এই জীবন সংগ্রাম এবং বেঁচে থাকার আর্তি হাসানের সৃজনধর্মিতারই লক্ষণ। অল্প বয়সের লেখা, একটু কাঁচা, তবু হাসান আজিজুল হকের প্রস্তুতির স্ফুরণ এতে মূর্ত হয়েছে।

ঢাকার ‘কালি ও কলম’ এবং ‘শিল্প ও শিল্পী’ পত্রিকার সম্পাদক

আরও পড়ুন
Advertisement