চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

নারীর বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী আলেখ্য

সিমায় চলছে ‘ড্রয়িংস অ্যান্ড ইন বিটুইন’ শীর্ষক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষবাংলায় যাকে রেখাচিত্র বলা হয়, ইংরেজিতে বিভিন্ন নামের মধ্যে তার নানা রকম প্রকারভেদ থাকে। যেমন ড্রয়িং, স্কেচ, ডুড্ল, জটিং ইত্যাদি। যে নামেই ডাকা হোক, এই বিশেষ প্রকরণটির মধ্যে শিল্পীর স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতা পরিস্ফুট হওয়ার সুযোগ থাকে। একজন শিল্পী পূর্ণাঙ্গ চিত্র আঁকেন বহির্বিশ্বের জন্য। সেখানে তাঁর ভিন্ন এক সচেতনতা কাজ করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১

বাংলায় যাকে রেখাচিত্র বলা হয়, ইংরেজিতে বিভিন্ন নামের মধ্যে তার নানা রকম প্রকারভেদ থাকে। যেমন ড্রয়িং, স্কেচ, ডুড্ল, জটিং ইত্যাদি। যে নামেই ডাকা হোক, এই বিশেষ প্রকরণটির মধ্যে শিল্পীর স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতা পরিস্ফুট হওয়ার সুযোগ থাকে। একজন শিল্পী পূর্ণাঙ্গ চিত্র আঁকেন বহির্বিশ্বের জন্য। সেখানে তাঁর ভিন্ন এক সচেতনতা কাজ করে। কিন্তু ড্রয়িং-এর ক্ষেত্রে বাইরের কোনও দায় নাও থাকতে পারে। এ জন্য আত্মমগ্নতার স্বতন্ত্র ও স্বাধীন প্রকাশ রেখাচিত্রে বিশেষ এক নান্দনিক মাত্রা আনে। সুদূর অতীত থেকে সারা বিশ্ব জুড়ে রেখাচিত্রের যে বিপুল বৈচিত্র, তাকে নির্দিষ্ট কোনও একক সংজ্ঞায় বাঁধা যায় না। এই বৈচিত্রই এই আঙ্গিকটির বৈশিষ্ট্য।

সিমা গ্যালারিতে এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ড্রয়িং-এর একটি সম্মেলক প্রদর্শনী। শিরোনাম ‘ড্রয়িংস অ্যান্ড ইন বিটুইন’। সেখানে এই আঙ্গিকটির নানা বৈচিত্র ও ব্যাপ্তি লক্ষ করা গেছে। ‘ইন বিটুইন’ শব্দ দুটির মধ্যে সেই প্রসারণেরই ইঙ্গিত থাকে। যে ৬৪টি রচনা প্রদর্শিত হয়েছে তাতে আমাদের আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদের বিবর্তনের একটি রূপরেখাও উঠে আসে।

Advertisement

আধুনিকতাবাদের একেবারে সূচনাপর্বের তিন শিল্পীর কাজ যদি আমরা লক্ষ করি, তা হলে প্রকাশের তিনটি আলাদা ধরন আমরা চিনে নিতে পারি। গগনেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী— এই তিন শিল্পীর কাজের মধ্যে গগনেন্দ্রনাথের জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে করা কৌতুকদীপ্ত কার্টুনধর্মী রচনাটি যতটা সম্পূর্ণত রেখা-নির্ভর, ছায়াতপের কিছু ব্যবহার সত্ত্বেও, অন্য দুই শিল্পীর কাজ তা নয়। রবীন্দ্রনাথের রহস্যময়ী নারী-মুখাবয়বটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র হিসেবেও গণ্য হতে পারে। রেখার সংহত কারুকাজ সেখানে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা এনেছে, যা আর শুধু মাত্র রেখাচিত্রের সীমায় আবদ্ধ থাকে না। উপেন্দ্রকিশোরের রচনা সম্পর্কেও সে কথা বলা যেতে পারে। উপেন্দ্রকিশোরের ‘হিন্দুস্থানী উপকথা’ চিত্রায়ণের তিনটি ছবি এখানে দেখানো হয়েছে। ছবিগুলি কালি ও জলরঙে আঁকা। তাঁর শিশুসাহিত্য ও মুদ্রণ-প্রকরণের বৈভবে তাঁর চিত্রীসত্তাকে আমরা অনেক সময় ততটা মনে রাখি না। আলোচ্য প্রদর্শনীটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে উপেন্দ্রকিশোরের এই তিনটি ছবি দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

আদর্শ রেখাচিত্রের দৃষ্টান্ত হিসাবে গণ্য করা যায় যামিনী রায়ের ‘নারী’ অবয়বটিকে। পরিমিতির মধ্য দিয়ে রেখাকে কত বাঙ্ময় করা যায়, এই রচনাটি আমাদের তা বুঝতে সাহায্য করে। লৌকিকের এই ঐশ্বর্যই সমৃদ্ধ করেছে পরবর্তী প্রজন্মের শান্তিনিকেতন ঘরানার একজন শিল্পীর কাজকে। তিনি ১৯৬০-এর দশকের শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। রেখার সুরেলা জঙ্গমতার অনবদ্য দৃষ্টান্ত তাঁর দুটি নারী-অবয়ব। আবার এই শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যই আধুনিকতাবাদী মননে সমৃদ্ধ হয়ে রেখারূপকে কত সংবৃত, পরিমিত ও নৈর্ব্যক্তিক করে, তার দৃষ্টান্ত সুষেণ ঘোষের কালি-কলমের চারটি রচনা। তাঁর ভাস্কর্যের মতোই গাণিতিক বা জ্যামিতিক বিমূর্ততার অসামান্য দৃষ্টান্ত এগুলি। নাটকীয়তা বা আখ্যান নিরপেক্ষতার সমধর্মী প্রকাশ দেখা যায় ইউসুফ বা পালানিপ্পনের কাজে।

এর বিপরীত প্রান্তে অবস্থান আদিবাসী শিল্পী ময়ঙ্ককুমার শ্যামের রেখা ও ছায়াতপের জালিকায় তৈরি মাকড়শা ও মাছেদের খেলার দৃশ্যটি। আদিবাসী শিল্পে সমগ্র প্রকৃতি যেভাবে নন্দিত হয়, নাগরিক শিল্পে তার তুলনা বিরল। নাগরিকতার ভিতরে প্রাকৃতিক আনন্দের ছবি এঁকেছেন বীণা ভার্গব। অজস্র পায়রা উড়ছে শহরের বস্তির চালাঘরের উপরে। সম্মুখপটে বসে আছে এক বিমর্ষ মানবী। উপরে রয়েছে কিছু সংকেতচিহ্ন। কিন্তু এই রচনাটিকে কি ড্রয়িং-এর সীমায় আবদ্ধ রাখা যায়? অর্পিতা সিংহের রচনাটি ড্রয়িং-এর ব্যতিক্রমী প্রকরণ নিয়ে অভিনব পরীক্ষা-নিরীক্ষার দৃষ্টান্ত। শিরোনাম ‘চুলে তোমার ফুল রেখো না।’ সবটাই কালি কলমে আঁকা, তবু মনে হচ্ছে যেন কাটা কাগজ সেঁটে গড়ে তোলা হয়েছে রচনাটি। আর সেই কাটা কাগজে ইংরেজিতে লেখা ওই কথাগুলোই প্রতিফলিত হচ্ছে ‘চুলে তোমার ফুল রেখো না।’ নারীর বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী আলেখ্য। পরেশ মাইতির ‘প্রভাতের ব্যায়াম’ শীর্ষক রচনায় একটি কুকুরের অসামান্য রৈখিক উপস্থাপনা। এই প্রদর্শনী বুঝতে সাহায্য করে আজকের তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবনী প্রতিভা অনেক গভীর ও ব্যতিক্রমী। সুমিত্র বসাক, চিন্তন উপাধ্যায়, সারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আবির কর্মকারের রচনা এর দৃষ্টান্ত।

আরও পড়ুন
Advertisement