পুস্তক পরিচয় ২

নীতীশ অনেক কিছুই পাল্টাতে চেয়েছিলেন

সত্তর দশকের গোড়ার দিকে বিহার সম্পর্কে এক নিবন্ধে গ্রন্থকার ও সাংবাদিক ট্রেভর ফিশলক লিখেছিলেন, বিহার হল ভারতবর্ষের নালা! ‘স্যয়ার অব ইন্ডিয়া’। ‘বিহারি’ ভাবাবেগকে আঘাত দিতে ওই একটি বাক্যই হয়তো যথেষ্ট। তার পর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি দশক। কিন্তু বিহার কতটা এগোল? আরও কতটা পথ পেরোলে তবে ‘উন্নত’ রাজ্য হবে বিহার?

Advertisement
তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৩০

সত্তর দশকের গোড়ার দিকে বিহার সম্পর্কে এক নিবন্ধে গ্রন্থকার ও সাংবাদিক ট্রেভর ফিশলক লিখেছিলেন, বিহার হল ভারতবর্ষের নালা! ‘স্যয়ার অব ইন্ডিয়া’। ‘বিহারি’ ভাবাবেগকে আঘাত দিতে ওই একটি বাক্যই হয়তো যথেষ্ট। তার পর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি দশক। কিন্তু বিহার কতটা এগোল? আরও কতটা পথ পেরোলে তবে ‘উন্নত’ রাজ্য হবে বিহার?

দলিত ও পিছড়ে বর্গের ভোটব্যাঙ্ক সম্বল করে ১ নম্বর অ্যানে মার্গে অধিষ্ঠান ঘটেছিল ‘গরিবোঁ কা মসিহা’ লালুপ্রসাদের। বিহারের সঙ্গেই গোটা দেশ দেখেছিল, একদা জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা লালু কী ভাবে ধীরে ধীরে গরিবের আস্থা অর্জন করেছিলেন। মনে করা হচ্ছিল, যে মাটির গন্ধ নিয়ে ক্ষমতার কুর্সিতে বসেছেন লালু, সেই মাটিতেই পা থাকবে তাঁর। কিন্তু বাস্তবে কি তা হল? নানা দুর্নীতি ও পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির জেরে টলে গেল পিছড়ে বর্গের সেই অহঙ্কার।

Advertisement

লালুর জেলে যাওয়া, কুর্সিতে রাবড়ি দেবীর অধিষ্ঠান, এ সব তথ্যই বহুশ্রুত। আর তারও অনেক পরে উত্থান হল যাঁর, সেই নীতীশ কুমার প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি সঙ্গী ছিলেন লালুর। একদা এই লালুই তাঁকে এনেছিলেন রাজনীতির আঙিনায়। নীতীশের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এখানে একটি তথ্যের উল্লেখ করা প্রয়োজন। দেশের যে ক’টি রাজ্যে প্রথম জমিদারি প্রথার বিলোপ হয়, বিহার তাদের অন্যতম। এ ব্যাপারে ১৯৫০ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়। ’৯০ সালে লালুপ্রসাদ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বিহার বিধানসভায় ১২৩ জন ভূস্বামীর একটি তালিকা পেশ করেন। সেখানে তাঁর ঘোষণা ছিল, ওই ভূস্বামীদের হাত থেকে অতিরিক্ত জমি কেড়ে নিতে তিনি বিশেষ কয়েকটি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। যদিও এর পরে আর এ সম্পর্কে কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি।

এখানেই তফাত হয়ে যায় লালুপ্রসাদের সঙ্গে নীতীশ কুমারের। আর এই প্রসঙ্গটি চমৎকার ভাবে এনেছেন সাংবাদিক সঙ্কর্ষণ ঠাকুর তাঁর বইয়ে। পশ্চিমবঙ্গে ‘অপারেশন বর্গা’-খ্যাত দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিহারে এনে নীতীশ চেয়েছিলেন, সেখানেও ভূমি সংস্কারে সাফল্য আসুক। নীতীশ তাঁকে মুক্ত ভাবে কাজও করতে দিয়েছিলেন। দেবব্রতবাবু ২০০৮-এ তাঁর সুুপারিশ জমা দেন। সরকার রিপোর্ট প্রকাশ করার আগেই কিন্তু তার বিশেষ কিছু অংশ ফাঁস হয়ে যায়। বোঝা যায়, ভূস্বামীদের শায়েস্তা করতে কোন পথে হাঁটতে চলেছেন নীতীশ। আগুনে ঘি পড়ে। যার আঁচ সামলাতে পারেননি তিনি। ২০০৯-এ ১৮টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে সংযুক্ত জনতা দল (জেডিইউ) পায় মাত্র দু’টি আসন এবং বিজেপি পায় তিনটি।

সিঙ্গল ম্যান/ দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব নীতীশ কুমার অব বিহার,

সঙ্কর্ষণ ঠাকুর। হার্পার কলিন্স, ৫৯৯.০০

একদা জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নীতীশের রাজনৈতিক উত্থান, মঞ্জুদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে, বখতিয়ারপুরের বাড়িতে স্ত্রীকে রেখে পটনায় নীতীশের লড়াই— উঠে এসেছে একের পর এক অধ্যায়। সঙ্কর্ষণও জন্মসূত্রে ‘বিহারি’। কর্মসূত্রে দিল্লিতে থাকলেও বারে বারে ফিরেছেন বিহারে। এই বইয়ে মিলেমিশে গিয়েছে ব্যক্তি সঙ্কর্ষণের নানা ভাবাবেগ, নানা মানুষের কথা। ঠিক যে ভাবে লিখেছিলেন লালুপ্রসাদ যাদবের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে সাবঅল্টার্ন সাহেব

লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। জনমত সমীক্ষা আঁচ দিচ্ছে, জনপ্রিয়তা কমছে নীতীশের। ভোট কম পেতে চলেছে জেডিইউ। এগিয়ে যাচ্ছে মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি। রাজনৈতিক আঁতাঁতের বাধ্যবাধকতায় যে বিজেপি-র হাত ধরেছিলেন নীতীশ, ২০১৩-র জুনে সেই বিজেপি-সঙ্গ ত্যাগ করেছেন তিনি। যবে থেকে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরেছে নরেন্দ্র মোদীর নাম, তবে থেকেই নীতীশের সঙ্গে বিজেপি নেতৃত্বের বিরোধ। নীতীশ চেয়েছিলেন, মোদী নয়, ধর্মনিরপেক্ষ কাউকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরুন বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু সে কথা রাখেনি বিজেপি। অতএব, রাস্তা বদলে ‘একলা চলো’ নীতি নিয়েছেন নীতীশ কুমার। তবে, স্রেফ কুর্মি ভোটের উপরে নির্ভর করে নির্বাচনের এই অকূল দরিয়া তিনি পার হতে পারবেন কি না তা বোঝা যাবে আগামী ১৬ মে।

অথচ, এই নীতীশই স্বপ্ন দেখিয়েছেন ‘নয়া বিহার’-এর। পাল্টাতে চেয়েছেন অনেক কিছুই। এবং তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম পাঁচ বছরে বিহার পাল্টেছে ঝড়ের গতিতে। ২০১০-এর নভেম্বরে তাঁর নেতৃত্বাধীন জেডিইউ-বিজেপি জোট বিহার বিধানসভার ২৪৩টি আসনের মধ্যে পেয়েছিল ২০৬টি (জেডিইউ ১১৫, বিজেপি ৯১)।

নরেন্দ্র মোদী এখন যাবতীয় আকর্ষণের কেন্দ্রে। বেশ কিছুটা দূর থেকে আস্ফালন করছেন নীতীশ। ‘বিহার না শুধরি’— এই আপ্তবাক্যকে কিছুটা হলেও ভুল প্রমাণ করেছিলেন যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আকর্ষণীয় ঢঙে, ঝরঝরে ভাষায় তাঁকে ফুটিয়ে তুলেছেন সঙ্কর্ষণ।

আরও পড়ুন
Advertisement