প্রত্যেক মানুষেরই একটা আত্মজীবন আছে, সেটা যতক্ষণ না বৃহত্তর জীবনমণ্ডলের সঙ্গে যুক্ত হয় ততক্ষণ আত্মজীবনীর বিষয়ভূত হয় না। প্রায় পৌনে শত বছর জীবৎকালের অধিকারবলে এবং বিচিত্র কর্মোদ্যোগের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে পবিত্র সরকার মহোদয় আত্মজীবনী লেখার একটা অবকাশ নিয়েছেন। আর পাঁচটা জীবনের মতোই তাঁর জীবনও কিছু বিচিত্র ঘটনাবাহী হয়ে আছে। তাতে কৌতুক-কৌতূহল দুই-ই আছে, কিন্তু তাতে বিতর্ক ছিল না তেমন। জন্মদাতা-দাত্রী পিতা-মাতা বর্তমান থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়তার বিচিত্রযোগে তাঁর পিসেমশাই-পিসিমারা তাঁর পালক পিতা-মাতা হয়ে উঠে তাঁর জীবনে যে একটা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাতে অবশ্যই একটা ‘আলাদা’ ব্যাপার আছে। দেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার মধ্যেও আজ চমক নেই। কিন্তু যখন দেশটা ভাগ হয়ে বিদেশ হয়ে যায় তার ধাক্কাটা জন্মভূমির লালনকে যে-ভাবে নির্জিত করে, তার ফলেই তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মানুষগুলির জীবনধারা আশ্চর্য ভাবে বদল হয়ে গিয়েছিল। নইলে হয়তো পবিত্রবাবুর খড়্গপুরে বড় হয়ে ওঠার ব্যাপারটা ঘটত না। খড়্গপুর তাঁর পালিকা মাতার মতো পালিকা মাতৃভূমিও হয়ে উঠেছিল। তাই ছোটবেলাটা দেখতে গিয়ে তাঁকে অনেক সময় বড়বেলার সঙ্গে জড়িয়ে দেখতে হয়েছে। ছোটবেলার সবচেয়ে বড় পাওনা ছিল হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির মধ্যে বেড়ে ওঠা।
অল্প-পুঁজির জীবন, পবিত্র সরকার।
প্রতিভাস, ২০০.০০
বড়বেলার পবিত্রবাবুর ছাত্রজীবন, অধ্যাপনাজীবন ইত্যাকার ব্যাপার ‘অ-সাধারণ’ কিছু হয়তো ছিল। কিন্তু এই সময়েই তাঁর জীবনে নানা বিতর্ক এসে বাসা করে নিতে শুরু করে। এটাই তাঁর আত্মকথা পড়ার কৌতূহলকে অগ্রবর্তী করে দেয়। তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকাকে তাঁর বিরোধীপক্ষ খুব সাদা চোখে দেখেননি, তাঁর উপাচার্যত্বও নিষ্কণ্টক ছিল না। বিধানসভার লবি থেকে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাগুলি নানা সময়ে তাঁকে কেন্দ্র করে আলোড়িত হয়েছিল। আত্মজীবনী লেখকও এই বিতর্ককে এড়িয়ে যেতে পারেননি।
বি এ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে কলেজের অধ্যক্ষ জগদীশ ভট্টাচার্যকে প্রণাম করতে এলে তিনি যখন বলেন, বহু কাল বাদে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে একটা ছাত্র প্রথম হল, তখনই বুঝতে পারি তাঁর ছাত্রজীবন দেশকালের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চলেছে ধামরাই হার্ডিঞ্জ স্কুলের ছেলে অতঃপর প্রথম হওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রাইজ দেওয়ার সময় বই উপহার দেননি বলে যাঁর দুঃখ হয়, তাঁর আত্মকথা একটু আলাদা রকমের হবে বইকি। ঘটি-বাঙালের দ্বন্দ্ব এবং হিন্দি সিনেমার মতো প্রসঙ্গ তখন তুচ্ছ হয়ে যায়, একটি অধ্যায় নাম পায় ‘বই পড়ার জগতে’। টাকা চুরি করে বই কেনার নেশাকে মুজতবা আলি সাহেব বোধ করি ‘বুঁদ’ হওয়া বলেছিলেন। পাড়ার জয়রামদাদা তাঁকে মিলন মন্দির পাঠাগারের পথ যে ভাবে দেখিয়েছিলেন, তাতে কেবল মনে হয় পাড়ায় পাড়ায় এখন জয়রামদাদাদের খুব দরকার।
যে কোনও আত্মজীবনীর একটা বড় আকর্ষণ লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু রোমাঞ্চকর বা রোমান্সবাহী ঘটনা। সে সবের জন্য পাঠক তাঁর অল্প বয়সের এই পুঁজি-র খোঁজ নিয়ে নেবেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু নারায়ণ চৌবের প্রভাব এবং তজ্জনিত ছাত্র-রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েও তাঁর উগ্রতা সীমা লঙ্ঘন করেনি সম্ভবত যদিও দুঃসাহসে তাঁর বরাবর উৎসাহ ছিল। ‘ছাত্রদেরও পার্টির আওতায় নিয়ে আসা’ কার্যক্রমে বিশ্বাসী পবিত্রবাবু কিন্তু তাঁর অভিনয়জীবন সম্পর্কে একটু কৃপণতা করেছেন। অধ্যাপক না হয়ে তিনি এক জন ভাল নট হতে পারতেন, যেমন বিরুদ্ধ পরিবেশে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার একটা স্বতোচ্চারিত অধিকার প্রকাশে তিনি বরাবরই অনুরাগী। যে পুরী একদা রবীন্দ্রনাথকে কারারুদ্ধ করার কথা ভেবেছিল, সেই পুরীতেই রামকৃষ্ণ মিশনের গ্রন্থাগারে তিনি ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন ‘গীতবিতান’-এর তিনটি খণ্ড। পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষক সব্যসাচী গুপ্ত ছিলেন তাঁর রোল মডেল। আজও রবীন্দ্রনাথ তার নিত্য সঙ্গী।
অনেক মনোহর আখ্যানে বইটির সতেজ প্রাণময়তা। তাঁর জন্মতারিখ যা-ই হোক, তাঁর স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ডে জন্মদিন লেখা হয় ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮। এমন পরিবর্তন অনেকেরই ঘটে। কিন্তু তাঁর সহপাঠী ৫৬ জন ছাত্রেরই বয়স সে বারে লেখা হয়েছিল ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮! তাঁর শিক্ষকবৃত্তের কহানি কম আকর্ষক নয়, কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে প্রোজ্জ্বল ব্যক্তিত্বময়ী, শক্তিময়ী ও স্নেহময়ী তাঁর ছোট মা। এমনই করতে করতে খড়্গপুরের জীবনও শেষ হয়ে এসেছিল। বড় মাপের মানুষদের সাহচর্য তাঁকে ক্রমশ নির্মাণ করে তুলেছিল, শেষে এলেন ‘দীঘল চেহারার শ্যামা মেয়ে। চোখ দু’টি টানা-টানা, হাসলে চমৎকার সুশ্রী দাঁতের সারি’, সচ্ছল-সুন্দর তাঁর গেহিনী।
এটি ‘প্রথম পর্ব’ জেনেও বার বার মনে হচ্ছে কলকাতা জীবনের প্রথম পর্বের এই ইতিকথা যেন অসম্পূর্ণ। পরের পর্ব জানার জন্যে আকাঙ্ক্ষা জেগে রইল। দ্বিতীয় পর্ব পড়ার এই বাসনাটি বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে কোনও কোনও প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও এই অন্তঃশায়ী টানটাকেই। সেখানের ‘পুঁজি’টা তো ‘অল্প’ হবে না আদৌ।