পুস্তক পরিচয় ২

দুই বিপরীত জগতের সংঘর্ষ

সত্যজিৎ রায়ের আগে ভারতীয় ছবিকে পরিত্যক্ত ব্রিটিশ-উপনিবেশের ছিবড়ে ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারত না পশ্চিমি দেশগুলো, সেখানকার ফিল্মবেত্তাদের চোখে সে ভাবেই প্রতিভাত হত আমাদের দেশটা। কারণ, তাঁরা কোনও দিনই ভারতীয় সিনেমাকে ‘সিরিয়াসলি’ নেননি, এ ধরনের সিনেমা তাঁদের কাছে নিছকই হলিউডের ‘নেটিভ’ সংস্করণ।— প্রায় এ রকমই মন্তব্যে শ্যাম বেনেগাল বলিউড নামক ফুলে-ফেঁপে-ওঠা ভারতীয়দের গর্বের বেলুনটাকে এক খোঁচায় চুপসে দিয়েছেন।

Advertisement
শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১

Advertisement

নট জাস্ট বলিউড, তুলা গোয়েঙ্কা। ওম, ৩৯৫.০০

দ্য ফ্রন্ট রো, অনুপমা চোপড়া। হার্পার কলিন্স, ৩৯৯.০০

তপন সিংহ-র ফিল্ম-মেকিং, নন্দন মিত্র। চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, ১৪০.০০

সত্যজিৎ রায়ের আগে ভারতীয় ছবিকে পরিত্যক্ত ব্রিটিশ-উপনিবেশের ছিবড়ে ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারত না পশ্চিমি দেশগুলো, সেখানকার ফিল্মবেত্তাদের চোখে সে ভাবেই প্রতিভাত হত আমাদের দেশটা। কারণ, তাঁরা কোনও দিনই ভারতীয় সিনেমাকে ‘সিরিয়াসলি’ নেননি, এ ধরনের সিনেমা তাঁদের কাছে নিছকই হলিউডের ‘নেটিভ’ সংস্করণ।— প্রায় এ রকমই মন্তব্যে শ্যাম বেনেগাল বলিউড নামক ফুলে-ফেঁপে-ওঠা ভারতীয়দের গর্বের বেলুনটাকে এক খোঁচায় চুপসে দিয়েছেন। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ যে পশ্চিমি সিনেমারসিকদের ভাবতে বাধ্য করল, এই প্রথম একজন ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভাষায় কথা বলছেন, সে কথাও জানাতে ভোলেননি তিনি।

কিছু কাল ধরে ভারতীয় ছবি-করিয়েদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তুলা গোয়েঙ্কা, সেগুলি একত্র করে বেরিয়েছে নট জাস্ট বলিউড, তাঁর এই নামকরণ বইটির পাঠককে একটু হাঁফ ছাড়ার অবকাশ এনে দিয়েছে, যে ভাবে আজকাল ‘বলিউড = ভারতীয় সিনেমা’ সমীকরণটি পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছে! ভূমিকায় লিখেওছেন তুলা: ‘অল ইন্ডিয়ান সিনেমা ইজ নট বলিউড...’, কথাটি থেকে কেউ নিশ্চিত ভাবে উল্টোটাও বলতে পারেন, ভারতীয় ছবি মাত্রেই না হয় বলিউড নয়, কিন্তু বলিউড মানেই তো ভারতীয় ছবি।

মানতে নারাজ আদুর গোপালকৃষ্ণন। তাঁর সাক্ষাৎকারে ‘বলিউড’ শব্দটাই ব্যবহার করতে চাননি, বরং বলেছেন, কোথায় সীমাবদ্ধ এই ‘পপুলার বম্বে সিনেমা’, কখনও তা নির্দিষ্ট মানুষজন, তাদের নির্দিষ্ট সমস্যা বা সংকট, বা প্রকৃত বাস্তব তুলে আনে না পর্দায়, বিপরীতে এক ‘প্যান-ইন্ডিয়ান সেন্টিমেন্ট’ গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করে, চট করে যা সেঁধিয়ে যেতে পারে ‘তথাকথিত’ সাধারণ মানুষের মনে। গিরিশ কাসারাভাল্লি আর জব্বর পটেল-এর সাক্ষাৎকারেও পাওয়া গেল ভারতীয়তার নামে এই বলিউড-বর্গীকরণের বিরোধিতা, সাংস্কৃতিক বহুস্বরকে একটেরে করে ফেলার চেষ্টায় আপত্তি। স্বাভাবিক নিয়মেই মৃণাল সেনও আছেন এঁদের মধ্যে, ‘ছবিতে কি বিনোদন খোঁজে দর্শক’— এ প্রশ্নের উত্তরে তাঁর ঠোঁটকাটা জবাব: ‘আই ডোন্ট কেয়ার হোয়াট দে ওয়ান্ট’। মৃণালবাবুর সঙ্গে ‘ইস্ট’ বিভাগে রয়েছে বুদ্ধদেব-অপর্ণা-গৌতম-ঋতুপর্ণর সাক্ষাৎকার, আছেন মীরা নায়ারও, অথচ ‘সাউথ’ বিভাগে নেই এম এস সথ্যু। কেন? তাঁর অবিস্মরণীয় ‘গরম হাওয়া’র কথা কি করে ভুলে গেলেন তুলা? আর ‘মিডল সিনেমা’য় মহেশ ভট্ট আছেন, নেই বাসু চট্টোপাধ্যায়। ‘মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা’য় অনুরাগ কাশ্যপ আছেন, নেই দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়। রীতিমতো দৃষ্টিকটু।

এর বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া অনুপমা চোপড়ার সাক্ষাৎকারের সংকলনটি, দ্য ফ্রন্ট রো। এতে বলিউডের অভিনেতা-পরিচালকদের সঙ্গে কথোপকথন, নজরকাড়া ছবিগুলি নিয়েও গোলটেবিল। অনুপমার পরিশ্রমে উজ্জ্বল হয়ে ফুটেছে নতুন শতকের বলিউড, মিডিয়া আর ইন্ডাস্ট্রি হাত ধরাধরি করে চললে বিশ্বের বাজারে এ দেশের সিনেমার দর কতটা বাড়িয়ে তোলা যায়, তার একটা হদিশ এনে দেয় সাক্ষাৎকারগুলি। পাশাপাশি দু’টি বই ভারতীয় সিনেমার দুই বিপরীত জগতের সংঘর্ষের চেহারাছবি স্পষ্ট করে দেয়, ভারতীয় ছবি-করিয়েদের দর্শনের সংঘাতটা টের পাবেন পাঠক।

তপন সিংহর ছবি তৈরির নানা দিক নিয়ে তাঁর ছবির নেপথ্যের লেখক-কলাকুশলীদের বিস্তারিত কথাবার্তা, নন্দন মিত্রর সাক্ষাৎকারের সংকলনে পরিচালকের মনটিকে বুঝতে সাহায্য করে। স্পষ্ট করে দেয় তপনবাবুর ছবি তৈরির অভিপ্রায়, যা মৃণালবাবুর ঠিক বিপরীত: ‘আমার যেমন ছবি দেখতে ভালো লাগে, আমিও আমার ছবি দর্শককে ভালো লাগাব।’

আরও পড়ুন
Advertisement