চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

চোখ ও মুখের অভিব্যক্তিতে ধ্যানের তন্ময়তা

সম্প্রতি রামকৃষ্ণ মিশন আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত প্রমথনাথ মল্লিকের প্রদর্শনীটি দেখলেন মৃণাল ঘোষকলকাতায় গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের প্রদর্শনী বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করে চলেছে প্রতি বছর। প্রদর্শনীর মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরছেন এই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। আমাদের এই বাংলায় শিল্পকলার কোনও প্রকৃষ্ট দৃশ্য-ইতিহাস নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৬ ০১:০২

কলকাতায় গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের প্রদর্শনী বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করে চলেছে প্রতি বছর। প্রদর্শনীর মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরছেন এই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। আমাদের এই বাংলায় শিল্পকলার কোনও প্রকৃষ্ট দৃশ্য-ইতিহাস নেই। এমন কোনও নির্ভরযোগ্য সংগ্রহালয় নেই যেখানে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের প্রথম কয়েক দশকের শিল্পীদের কাজের সুচারু সংগ্রহ আছে। ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতাবাদী ও নব্য-ভারতীয় ঘরানার অনেক শিল্পীর কাজের সঙ্গেই তাই আজ আমাদের পরিচয় নেই। এরকম একটা শূন্যতার পরিস্থিতিতে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রয়াস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের আর্ট-গ্যালারিতে চলছে প্রমথনাথ মল্লিকের (১৮৯৪-১৯৮৩) ভাস্কর্যের প্রদর্শনী। প্রায় ৫০-টি কাজের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা সম্ভব হল এই শিল্পীর সৃজনের পরিচয়। এটাও খুব আশাব্যঞ্জক যে এই কাজগুলি রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ শিল্পীর পারিবারিক সংগ্রহ থেকে নিজেদের সংগ্রহ নিয়ে ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট শিল্পতাত্ত্বিক অরুণ ঘোষ।

Advertisement

কলকাতায় ১৮৫৪ সালে স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট সূচনার সময় থেকেই মৃৎশিল্প শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। এম রিগো নামে এক শিল্পী তখন শেখাতেন। একেবারে শুরুতেই ক্লে-মডেলিং বিভাগে ৪৫ জন ছাত্র ভর্তি হয়েছিলেন। তারপর প্রতি বছরই অনেক ভাস্কর এখান থেকে বেরিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের ক’জনের কথা আজ আমরা জানি? ১৮৯৭ সালে ই বি হ্যাভেল যখন আর্ট স্কুলে ভারতীয় চিত্ররীতি শিক্ষার উপর জোর দেন, তখন প্রতিবাদে রণদাপ্রসাদ গুপ্তের নেতৃত্বে কিছু ছাত্র আর্ট স্কুল থেকে বেরিয়ে গিয়ে বউ-বাজারে জুবিলি আর্ট অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতাবাদী রীতির চিত্রভাস্কর্য শিক্ষা অক্ষুন্ন রাখা হয়। প্রমথনাথ ১৯১২ সালে চিত্রবিদ্যা শিখতে এখানেই ভর্তি হন। ভাস্কর্যে তাঁর আকর্ষণ থাকায় রণদাপ্রসাদের কাছে ভাস্কর্যও শেখেন। পরে কলকাতায় অবস্থানকারী মহারাষ্ট্রীয় ভাস্কর বিনায়ক পাণ্ডুরং কারমাকারের কাছেও তিন বছর ভাস্কর্য শেখেন। তখন ব্রিটিশ শিল্পপদ্ধতিতে স্বাভাবিকতাবাদী প্রতিকৃতি-ভাস্কর্যের উপরেই জোর দেওয়া হত বেশি। বিংশ শতকের প্রথম দুই দশকে ইউরোপে বিশেষত প্যারিসে ভাস্কর্যের আঙ্গিক নিয়ে যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, সে সম্পর্কে এখানকার ছাত্রদের কিছুই জানার সুযোগ দেওয়া হয় নি। প্রমথনাথও স্বাভাবিকতাবাদী প্রতিকৃতি ভাস্কর্যই বেশি করেছেন। পূর্ণাবয়ব ত্রিমাত্রিক মূর্তিও করেছেন, রিলিফেও অনেক কাজ করেছেন।

এই প্রদর্শনীতে চিত্তরঞ্জন দাশের একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি। এছাড়া অনেক অজানা ব্যক্তিত্বের, নারী ও পুরুষ, মূর্তিও রয়েছে। এই মূর্তিগুলিতে শিল্পীর দক্ষতা ছিল অবিসংবাদিত। রিলিফ পদ্ধতিতেও অনেক মুখাবয়ব ভাস্কর্য রয়েছে প্রদর্শনীতে। এর মধ্যে বিশেষভাবে তিনটি আকর্ষণ করে— শ্রীরামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশ চন্দ্র বসু।

রামকৃষ্ণের মূর্তিটি দণ্ডায়মান। হাঁটুর উপর থেকে পূর্ণ মূর্তিটি বিশেষ নৈপুণ্যে গড়েছেন শিল্পী। চোখে ও মুখের অভিব্যক্তিতে ধ্যানের তন্ময়তা রয়েছে। বাঁ-হাতের মুদ্রাতে এই সন্তের অনুচ্চারিত বাণী উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তিটি মুখের পার্শ্বচিত্র। কবির ব্যক্তিত্ব কল্পনাদীপ্তভাবে ধরা পড়েছে। জগদীশচন্দ্রের রিলিফ মূর্তিটিও খুবই সুষমাময়।

প্রতিকৃতি-ভিত্তিক কিছু রচনাধর্মী কাজে শিল্পীর নিজস্ব মননের পরিচয় থাকে। ‘টয়লেট’ বা প্রসাধন নামে একটি রচনায় আয়নার সামনে প্রসাধনরতা এক যুবতীকে ‌উপস্থাপিত করেছেন। ‘বোটম্যান’ শীর্ষক রচনায় একজন নগ্ন পুরুষ নৌকার উপর দাঁড়িয়ে লগি দিয়ে নৌকায় গতি সঞ্চারিত করছে। ‘সান অব দ্য সয়েল’ রচনায় লাঙল ও কাস্তে হাতে কৃষকের উপস্থাপনা।

‘অফারিং’ রচনায় দণ্ডায়মানা এক মানবী দুহাতে ফুল নিয়ে অঞ্জলি দিচ্ছে। স্বাভাবিকতাবাদী প্রতিকৃতিধর্মী রচনার সুন্দর দৃষ্টান্ত। সেই যুগে এরকম রচনার প্রচলনই ছিল বেশি।

এর পাশাপাশি ফুল নিয়ে কয়েকটি রচনা মনে রাখার মতো। স্বাভাবিকতাকে অতিক্রম করে এখানে শিল্পী যেন প্রতিচ্ছায়াবাদী মাধুর্যের দিকে গেছেন। স্মরণীয় তাঁর নানারকম মাছ নিয়ে করা রচনাগুলি, যার তুলনা তাঁর সমসাময়িককালে খুব বেশি ছিল না। তাঁর সৃজনশীল তন্ময়তার ইঙ্গিত আছে এই সব রচনায়।

আরও পড়ুন
Advertisement