পুস্তক পরিচয় ২

কেয়াকে আলোকবৃত্তে ফেরানোর প্রয়াস

কেয়া চক্রবর্তীর বর্ণময় জীবন ও কাজের মূল্যায়নের চেষ্টাও হয়তো তেমনই নিরন্তর লড়াই। ১২ মার্চ ১৯৭৭ সিনেমার শ্যুটিংয়ে স্টিমার থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দেন কেয়া। ৩৫ বছরের কেয়া সে সময় ‘নান্দীকার’-এর সর্বসময়ের নাট্যকর্মী। সেই অকালমৃত্যু জন্ম দিয়ে গেল এক অনন্ত বিতর্ক— পর্দার আড়ালের অজানা কাহিনি আর রহস্যের। এক অসামান্য প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী কেয়াকে নিয়ে প্রকাশিত দু’টি গ্রন্থেই তাঁকে নানা ভাবে দেখার প্রয়াস।

Advertisement
তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
আগুনের খেয়া, সম্পা: মধুময় পাল। সেতু, ৪৫০.০০

আগুনের খেয়া, সম্পা: মধুময় পাল। সেতু, ৪৫০.০০

এ যেন অনন্ত এক পরিক্রমা! পার্থিব জীবন হয়তো শেষ হয়েছে অকালে। কিন্তু ফেলে যাওয়া কাজ, ভাবনা আর সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা নিরন্তর এক লড়াইয়ের কাহিনি যেন তৈরি করে চলেছে জীবনের থেকেও বড় কোনও চালচিত্র।

কেয়া চক্রবর্তীর বর্ণময় জীবন ও কাজের মূল্যায়নের চেষ্টাও হয়তো তেমনই নিরন্তর লড়াই। ১২ মার্চ ১৯৭৭ সিনেমার শ্যুটিংয়ে স্টিমার থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দেন কেয়া। ৩৫ বছরের কেয়া সে সময় ‘নান্দীকার’-এর সর্বসময়ের নাট্যকর্মী। সেই অকালমৃত্যু জন্ম দিয়ে গেল এক অনন্ত বিতর্ক— পর্দার আড়ালের অজানা কাহিনি আর রহস্যের। প্রকাশ্যে এনে দিল ব্যক্তিত্বের সংঘাত-ত্যাগ এবং সেই ত্যাগকে বিস্মরণের অকথিত জীবননাট্যকেও। এক অসামান্য প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী কেয়াকে নিয়ে প্রকাশিত দু’টি গ্রন্থেই তাঁকে নানা ভাবে দেখার প্রয়াস।

Advertisement

কেয়ার জীবন নিয়ে নাট্যকর্মী দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্র ‘নাটকের মতো’ মুক্তি পেয়েছে সম্প্রতি। ওঁর নাট্যগোষ্ঠী ‘সংসৃতি’-র কেয়া চক্রবর্তী বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৫-এ। তার সঙ্গে কিছু নতুন লেখা ও ছবি সংযোজিত করে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। রয়েছে নান্দীকার-এর সে সময়কার বেশ কয়েকটি প্রযোজনার বিজ্ঞাপন। বাদল সরকার, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, তৃপ্তি মিত্র, কুমার রায়, বিভাস চক্রবর্তীর মতো নাট্যব্যক্তিত্ব নানা দিক থেকে কেয়ার জীবনকে দেখেছেন। কেয়াকে অন্য ভাবে দেখেছিলেন কবিতা সিংহ, চিত্তরঞ্জন ঘোষ। কেয়ার মা লাবণ্য চক্রবর্তীর মর্মস্পর্শী এক স্মৃতিকথাও রয়েছে। লাবণ্য বলছেন, ‘৬৪-তে কেয়া কলেজে জয়েন করে, আর ’৬৫-তে আমাকে নিয়ে বেড়াতে গেল একলাই— নাগাল্যান্ড, মণিপুর। ওর মধ্যে ভয়ডর কিছুই ছিল না। অথচ ছেলেবেলা থেকে একলা ও কোথাও বেরোয়নি।’

ভয়ডর যে ছিল না, সে প্রমাণ কেয়া পরে আরও অসংখ্য বার দিয়েছেন। ভাল নাট্যের সন্ধানে তাঁর নিজের যাত্রাও কি অনেকটা একলার ছিল না? কেয়ার ‘মিসেস আর. পি. সেনগুপ্ত’ রচনাটি এ ব্যাপারে আলো ফেলে— ‘অজিতদা বলেছিলেন, অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়াও। জীবনকে— মানুষকে যত জানবে, অভিনেত্রী হিসাবে তত বড়ো হবে।’ যাই ভাত বেড়ে দিই দেওরকে। অজিতদা, কী করে অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়াব? সামান্য অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে রাত করে ফিরতে মানা আমার।...সংসার বসে আছে...অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়ানো মেয়েদের কে চায়? চাহিদা না থাকলে জোগান দেব কাকে? তা ছাড়া সময় কই? সুতরাং আমি,— মিসেস আর. পি. সেনগুপ্ত— এঁটো পেড়ে, চায়ের বাসন ধুয়ে, সোজা স্টেজে চলে যাব।’

সম্পাদক হিসেবে আর একটি অসাধারণ কাজ করেছেন মধুময় পাল। ‘সম্পাদকীয়ের পরিবর্তে’ অধ্যায়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলেছেন মধুময়। এই গ্রন্থেও স্মৃতিচারণার পাশাপাশি কেয়ার লেখা নিবন্ধ, নাট্যপ্রবন্ধ, অনুবাদ, যাত্রা-নাটকের পর্যালোচনা, সাক্ষাৎকার সংকলিত হয়েছে। কেয়ার মৃত্যু-পরবর্তী বেশ কয়েক দিনের বিভিন্ন সংবাদপত্রের কর্তিকা এই গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ। নাট্যদলগুলিই নয়, কেয়ার অপমৃত্যুর রহস্যভেদের দাবিতে সরব হয়েছিল সে দিনের নগরজীবনও। কালের নিয়মেই অবশ্য তা স্তিমিত হয়ে গিয়েছে।

কেয়ার মৃত্যুর ঠিক চার বছর পরে কেয়ার শিক্ষক-সহকর্মী-সহমর্মী চিত্তরঞ্জন ঘোষ প্রকাশ করেন অসামান্য সংকলন কেয়ার বই। দুর্লভ এই বইটির অনেক লেখাই তুলে এনেছেন মধুময়। তুলে এনেছেন শঙ্খ ঘোষের সেই অবিস্মরণীয় লেখা ‘আগুন যখন জলে ঝাঁপায়’।

তাৎপর্যপূর্ণ এটাই যে, দু’টি গ্রন্থই উৎসর্গ করা হয়েছে চিত্তরঞ্জন ঘোষকে। ১৯৭৭-এর শারদীয় ‘পরিচয়’-এ চিত্তরঞ্জন লেখেন, ‘শ্মশানে কেয়াকে যখন ফুল-চন্দনে সাজিয়ে লোহার বাসরে শুয়ে দেওয়া হল, শত শিখার নাগিনী যখন তাকে দংশন করল, যখন আমাদের প্রাণ হাহাকার করে উঠল— আহা ওর বড় লাগছে!— তখন হঠাৎ অজিত [অজিতেশ] কেঁদে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কেয়া, তোমায় ভুলব না।’ সঙ্গে সঙ্গে সেই হাহাকার সমবেত শোকগর্জনে ফেটে পড়ল, ‘কেয়াদি, তোমায় ভুলব না, তোমায় ভুলব না।’... তখন লোহার বড় দরজা পড়ে গিয়েছিল। নইলে শোনা যেত একটা হাসি। শত-শিখার দংশনে শায়িত, গোটা ফুলটাই মশালে রূপান্তরিত হতে হতেও নিশ্চয়ই প্রবলভাবে হেসে উঠেছিল: ‘ভালোবাস? কতটা? আমার জন্য প্রাণ দিতে পার?’

প্রকৃতির নিয়মেই শোকের ঢেউ ক্রমে সরে যায়। কালের দেরাজের কোণে পড়ে থাকতে থাকতে সে মুখের উপরে আলপনা দেয় স্মৃতির ধুলো। তবু, সংকলিত এই দুই গ্রন্থ সেই কেয়াকে ফের যেন দাঁড় করিয়ে দিল মঞ্চের একেবারে মাঝখানে!

আরও পড়ুন
Advertisement