শিল্পী: সুমনা ঘোষ
সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে ‘মিনিয়েচার’ নিয়ে দ্বিতীয় সম্মেলক প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হল। উদ্যোক্তা ‘কালার ল্যান্ড আর্ট অ্যাকাডেমি’। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘মিনিয়েচার ১০১’। ১০১ জন শিল্পীর প্রত্যেকের দু’টি করে ছবি। প্রদর্শনী উপলক্ষে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এত ছবির সাধারণ ঐক্যের ক্ষেত্র একটাই। প্রত্যেকটি ছবিই ছোট আকারের। কিন্তু আঙ্গিক ও বিষয় বৈচিত্রে প্রত্যেকটি স্বভাবতই স্বতন্ত্র। ফলে প্রকাশের বহুমুখীনতা প্রদর্শনীটিকে উৎসবের আকার দিয়েছে। এখানে পাওয়া যায় সমকালীন চিত্রকলার সামগ্রিক চালচিত্রের আভাস। সাম্প্রতিকের জীবন-নিরীক্ষা এবং ঐতিহ্য-আত্তীকরণেরও বহুমুখী প্রয়াস প্রদর্শনীটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। পুরাণকল্প ভিত্তিক ঐতিহ্যগত আঙ্গিকের বিভিন্ন প্রকাশ যেমন এখানে দেখা যায়, তেমনি রয়েছে আধুনিকতার জটিলতা ও সংকটকে আত্মস্থ করার বিভিন্ন প্রয়াসও।
আকারে ছোট হলেই সে ছবি যে ‘মিনিয়েচার’ শ্রেণিভুক্ত হবে এমন কোনও কথা নেই। ইউরোপে মধ্যযুগে পাণ্ডুলিপি চিত্রণের অনুষঙ্গেই এই শব্দটি ব্যবহারের সূচনা। পাণ্ডুলিপি লেখার সময় প্রথম অক্ষরটিকে ছোট ছোট ছবি দিয়ে অলঙ্কৃত করা হত। যে কালিতে আঁকা হত, সেই ছবি বা অক্ষর, ল্যাটিন ভাষায় তাকে বলা হত ‘মিনিয়াম’। সেই থেকেই ‘মিনিয়েচার’ শব্দটির উদ্ভব। পরবর্তী কালে ছোটর ভিতরই নিপুণ কারুকাজ, যা হাতে তুলে অন্তরঙ্গ উপভোগ করা যায়।
অতিথি শিল্পীদের অনেকের কাজই বড় ছবির ছোট সংস্করণ হলেও তাতে বিশেষ এক নান্দনিক মাত্রা এসেছে। রবীন মণ্ডলের আঁকা পুরুষের মুখাবয়বটি আদিমতা-সম্পৃক্ত অভিব্যক্তিবাদী রীতির দৃষ্টান্ত। প্রকাশ কর্মকার এঁকেছেন নিসর্গদৃশ্য কণ্টকাকীর্ণ সরু গাছের সারির উপর উদিত সূর্য। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় নব্য-ভারতীয় ধারার অনুষঙ্গে এঁকেছেন বাউলের সঙ্গীত পরিবেশনের দৃশ্য। পার্থপ্রতিম দেব, জহর দাশগুপ্ত, দেবব্রত চক্রবর্তী, ওয়াসিম কাপুর বা সমীর আইচের ছবিতে আধুনিকতার যে জটিলতা, বড় ফ্রেমে তা হয়তো আরও ভাল খুলত। সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের সুষমাদীপ্ত নারীমুখাবয়ব ছোটতেই ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠতে পেরেছে। এদিক থেকে ছোট ছবি হিসেবে খুবই সার্থক চন্দ্রশেখর আচার্যের ছবিটি।
ঐতিহ্যগত আঙ্গিকে পুরাণকল্পমূলক বিষয়ের ছবির ধারা প্রাধান্য পেয়েছে। অর্জিতা সেনগুপ্ত এঁকেছেন মহিষের উপর উপবিষ্ট দেবী দুর্গার ছবি। অজয় কুমার সরকার গণেশ ও ইঁদুরকে সমন্বিত করে কৌতুকদীপ্ত প্রতিমা উপস্থাপিত করেছেন। অঞ্জন ভট্টাচার্য মধ্যযুগীয় অণুচিত্রের আঙ্গিকে রাধার ছবি এঁকেছেন। ধীরেন শাসমল ঐতিহ্যগত রূপকল্পকে আধুনিকতায় প্রসারিত করেছেন। তাঁর জলের ভিতর মাছের রচনাটিতে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটেছে। রুনু মিশ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাধা-কৃষ্ণের রূপায়ণটি নব্য-ভারতীয় ধারা অনুসরণের সফল দৃষ্টান্ত। একই আঙ্গিকে সমর বসাক এঁকেছেন শ্রীচৈতন্যের আলেখ্য। ঘরের চালায় ঝোলানো দুটি হাঁড়ি ও দুটি পাখি নিয়ে সুমিত দাস গ্রামীণ বিষয়কে স্নিগ্ধ দক্ষতায় রূপায়িত করেছেন। শম্ভু সাহার গরু-বাছুরের উপস্থাপনাটিও এরকমই স্নিগ্ধ রূপায়ণ। তৌবুল ইসলাম নৃত্যরতা নারীর আধুনিকতায় প্রসারিত করেছেন।
ঐতিহ্যদীপ্ত আঙ্গিকের পাশাপাশি আধুনিক ও আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকের প্রবাহ আরও বেশি সক্রিয় আমাদের সাম্প্রতিক ছবিতে। এই দুইয়ের সমন্বয়ের মধ্য দিয়েও চলছে আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ। অর্পিতা প্রধানের ছবিটির বিষয় খুবই সাধারণ। ফুলদানিতে ফুল। কিন্তু মূল বিষয় ও প্রেক্ষাপটের পরিসরকে তিনি ভেঙেছেন অভিব্যক্তিবাদী রীতিতে। আশিস সরকারের নিসর্গ রচনাটিও তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে এই ভাঙনের জন্যই। অরুণ কুমার মণ্ডল বা অভিশঙ্কর মিত্র ঐতিহ্যগত পুরাণকল্পকে আধুনিকতার আঙ্গিকের সঙ্গে সমন্বিত করেছেন। আলবার্ট অশোক ছুটন্ত মোষের ছবি এঁকেছেন স্বাভাবিকতাবাদী আঙ্গিকে। সুমনা ঘোষের দুটি ছবিও এই সমন্বয়ের দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। ফুলন্ত টগরগাছের পাশে ছায়াময় পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে আছে মানব-মানবী। অথবা জলস্রোতে ভাসছে এক মাটির কলসি। জলের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে যুগল। উপরে বৃক্ষ থেকে ঝুলছে একটি ফল। কাব্যময় রূপায়ণে শিল্পী চেতনার অন্তঃস্থলকে ছুঁতে চেয়েছেন।