চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...

ঐতিহ্য গবেষণায় আহিরিটোলা সুতানুটি হেরিটেজ

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অনুষ্ঠিত হল একটি প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ‘আহিরিটোলা সুতানুটি হেরিটেজ ট্রাস্ট’ গড়ে উঠল কলকাতার ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে। ড. অমিত ঘোষের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই সংস্থার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল সম্প্রতি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অঙ্গনে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল চিত্রভাস্কর্যের একটি প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর পরিকল্পনায় ছিলেন ইনা পুরী। ‘আকার প্রকার গ্যালারি’ ও ‘সিগাল’ সংস্থার সংগ্রহ থেকে নেওয়া হয়েছিল ছবি ও ভাস্কর্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১০
প্রদর্শনীর একটি ছবি

প্রদর্শনীর একটি ছবি

‘আহিরিটোলা সুতানুটি হেরিটেজ ট্রাস্ট’ গড়ে উঠল কলকাতার ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে। ড. অমিত ঘোষের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই সংস্থার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল সম্প্রতি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অঙ্গনে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল চিত্রভাস্কর্যের একটি প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর পরিকল্পনায় ছিলেন ইনা পুরী। ‘আকার প্রকার গ্যালারি’ ও ‘সিগাল’ সংস্থার সংগ্রহ থেকে নেওয়া হয়েছিল ছবি ও ভাস্কর্য।

প্রদর্শনীটি দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথম পর্যায়ে ছিল প্রখ্যাত শিল্পী কে.জি.সুব্রামনিয়নের ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিকে আঁকা একটি ম্যুরাল। ৩৬ ফুট ও ৯ ফুট দৈর্ঘ্য ও বিস্তারের এই ভিত্তিচিত্রটি মূল-অনুষ্ঠানমঞ্চের প্রেক্ষাপট হিসেবে উপস্থাপিত ছিল। ভিত্তিচিত্রের শিরোনাম: ‘ওয়ারস অব দ্য রেলিকস’। এই ছবির কেন্দ্রীয় ভাবনা সম্পর্কে ভূমিকা-স্বরূপ একটি লেখায় শিল্পী জানিয়েছেন: কারুর কাছে সত্য এক। কারুর কাছে তা বহু। সত্যকে বুঝতে মানুষ কিছু চিহ্ন ও প্রতীক তৈরি করে। তা মানবগোষ্ঠীকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে। কালক্রমে সেই সব প্রতীক তাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়। ঐক্যের বদলে তা আনে বিভেদ। বিশ্বাসের বদলে অবিশ্বাস ও হিংসা। আজ বিশ্বপরিস্থিতি এই অবিশ্বাসের সংঘাতেই পরিব্যাপ্ত।

Advertisement

এই ‘কনসেপ্ট’ বা ভাবনার ভিত্তি থেকে শিল্পী বিস্তার করেছেন তাঁর চিত্র প্রতিমা। অতীত ও বর্তমান, পুরাণকল্প ও বাস্তবের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে প্রতিটি প্রতিমা। প্রত্যেকে স্বতন্ত্র। অথচ পাশাপাশি সংস্থাপিত হয়ে একদিকে যেমন দৃশ্যতার নান্দনিক বন্ধন গড়ে তুলেছে, তেমনি গড়ে তুলেছে আপাত-আখ্যানহীন প্রতীকীবোধের সুসমঞ্জস এক মালাও। এক দিকে যেমন তা অলঙ্করণের সুষমায় ঝংকৃত, অন্য দিকে তেমনি গভীর বোধের ব্যঞ্জনায় প্রদীপ্ত। এক দিকে যেমন তা মানুষের ভিতরের পাশবিক প্রবৃত্তিকে পরিহাস ও বিদ্রুপ করছে, তেমনি মহত্ত্বেরও আলোকিত প্রতীক তৈরি করতে করতে অগ্রসর হয়েছে।

অনুষ্ঠান অঙ্গনের পিছনে একটি স্বতন্ত্র কক্ষে আয়োজিত হয়েছিল মূল প্রদর্শনীটি। সেখানে ছিল ১৯৪০-এর দশকের কয়েক জন প্রয়াত শিল্পীর ছবি ও ভাস্কর্যের পাশাপাশি সমকালীন অনেক শিল্পীর কাজও। বাংলার সাম্প্রতিক চিত্র-ভাস্কর্যের একটি সুনির্বাচিত সম্ভার ছিল এটি। কালীঘাটের পট, স্বাভাবিকতাবাদী চিত্রকলা, তারপর নব্য ভারতীয় ঘরানা— এ রকম বিবর্তনের পথেই চিত্র-ভাস্কর্যের ঐতিহ্য সাম্প্রতিকে এসে পৌঁছেছে। সেই ঐতিহ্যগত বিবর্তনের আভাস থাকলে সম্পূর্ণতর হতে পারত এই প্রদর্শনী।

চল্লিশের দশকের শিল্পীদের মধ্যে এখানে আমরা পেয়েছি প্রদোষ দাশগুপ্তের ভাস্কর্য, গোপাল ঘোষ, পরিতোষ সেন ও সোমনাথ হোরের ছবি। প্রদোষ দাশগুপ্তের ১৯৮৫-তে করা ব্রোঞ্জে ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ বুঝতে সাহায্য করে পাশ্চাত্য আধুনিকতা দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশছে। গোপাল ঘোষের জলরঙের দুটি রচনার মধ্যে ১৯৭৭-এর ছবিটি তাঁর নিজস্ব রীতির নিসর্গ। ১৯৮০-র রচনাটি একটু ব্যতিক্রমী। একটি রঙ্গমঞ্চের ত্রিমাত্রিক পরিসর গড়ে তোলা হয়েছে আলো-ছায়ার বিন্যাসে। সোমনাথ হোরের অনেকগুলি কালি-কলমের ড্রয়িং ছাপিয়ে তাঁর সাদার উপর সাদা পাল্পপ্রিন্টের ‘ক্ষত’ শীর্ষক ছাপচিত্রটি বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ঠিক পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী কে.জি.সুব্রামানিয়ন।

শর্বরী রায়চৌধুরীর রামকিঙ্করের ব্রোঞ্জ-মুখাবয়ব ভাস্কর্যটি অন্য এক তাৎপর্যে প্রাসঙ্গিক। শিল্পের পরম্পরায় রামকিঙ্করের উপস্থিতিকে তা তুলে ধরেছে। ১৯৬০-এর দশকের অন্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন গণেশ হালুই, সুনীল দাস, সুহাস রায়, মনু পারেখ ও বিকাশ ভট্টাচার্য। আশির দশকের আদিত্য বসাকের ছবিদুটি আধুনিকতার ভিতর ঐতিহ্যগত পুরাণকল্পের বিচ্ছুরণে অত্যন্ত ব্যঞ্জনাময়। এ ছাড়াও ছিল চিত্রভানু মজুমদার, জয়শ্রী চক্রবর্তী ও জয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি। প্রদর্শনীর তরুণতম শিল্পী ছিলেন শান্তিনিকেতনের মামুদ হোসেন লস্কর।

প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানে কলকাতার ঐতিহ্যগত ইতিহাস সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছিলেন জহর সরকার। তিনি দেখিয়েছিলেন অষ্টাদশ, ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ শিল্পীদের আঁকা কলকাতার ছবি। চিত্র-ঐতিহ্যের একটি দিকের উপর তা আলোকপাত করতে পেরেছে।

আরও পড়ুন
Advertisement