কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর বার্ষিক প্রদর্শনীটি ৮০-বছরে পদার্পণ করল। ৮০-তম বার্ষিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি। অ্যাকাডেমির পাঁচটি গ্যালারি জুড়ে। ১৯৩৩-এ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অ্যাকাডেমি। তখন এর অবস্থান ছিল ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, ২৭ চৌরঙ্গি রোড। নাম ছিল ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস। সেখানেই এর প্রথম প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয় ১৯৩৩-এর ২৩ ডিসেম্বর। পরবর্তী কালে এর নাম থেকে ‘ইন্ডিয়ান’ কথাটি বাদ দিতে হয় কিছু সাংগঠনিক-রাজনৈতিক কারণে।
এখন ক্যাথিড্রাল রোডে ‘অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস’-এর যে ভবনটির সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেখানে প্রদর্শনীর সূচনা হয় ১৯৬০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নন্দলাল বসুর ৫০-টি ছবির প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর আগ্রহে ও ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এই ভবনটি নির্মিত হয়। সূচনাকাল থেকেই কলকাতায় শীতের মরসুমে অ্যাকাডেমির বার্ষিক প্রদর্শনী ছিল একটি বর্ণময় আকর্ষণ। সারা ভারতের শিল্পকলার গতি-প্রকৃতি প্রতিফলিত হত এই প্রদর্শনীতে। কালক্রমে অ্যাকাডেমির সেই সুদিন অস্তমিত হয়েছে। নানা সাংগঠনিক সমস্যায় ভারাক্রান্ত হয়েছে এর নিয়মিত কার্যাবলি। বার্ষিক প্রদর্শনীর মানও অবনমিত হয়েছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই অনুষ্ঠিত হল এবারের ৮০-তম বার্ষিক প্রদর্শনী। এখনকার শিল্পপ্রবাহে প্রচলিত রীতির যে আঙ্গিকচর্চা, তারই প্রতিফলন প্রাধান্য পেয়েছে। তবে নতুন ভাবনার ইঙ্গিত এখানে বিশেষ কিছু নেই। তবু নির্বাচকমণ্ডলী ৭০০ কাজের ভিতর থেকে যে ১৮০-টি কাজ নির্বাচন করেছেন, তার মান খুব খারাপ নয়। ছ’জন শিল্পী পুরস্কৃত হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ প্রদর্শ হিসেবে রাজ্যপালের পুরষ্কার পেয়েছেন কৌশিক হালদার তাঁর ভাস্কর্যের জন্য। এছাড়া ১৬ জন শিল্পী পেয়েছেন ‘সার্টিফিকেট অব মেরিট’।
ভারতীয় চিত্ররীতির একটি স্বতন্ত্র ধারা এখনও এই প্রদর্শনীতে থাকে। এ বছর এই বিভাগে শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছে দেবদ্যুতি সাহার ‘এ মেটিরিয়ালিস্ট’ শিরোনামে টেম্পারার ছবিটি। মুঘল আঙ্গিকের দূরতর প্রতিফলন রয়েছে ছবিটিতে। কিন্তু যে ব্যঙ্গাত্মক কৌতুকের পরিমণ্ডল তৈরি করেছেন তাতে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংঘাত তৈরি হয়। আধুনিকতা দিয়ে শিল্পী ঐতিহ্যকে আঘাত করেছেন। ছবিটির বিষয় বাথরুমে কমোডে প্রাতঃকৃত্য করতে বসেছে এক নবাব। তার হাতে মোবাইল ফোন। পিছনে চাপরাশি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ট্রে। তাতে সম্ভবত একটি সাবানের কৌটো। শ্রেষ্ঠ গ্রাফিক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে ফহেমা আহমেদ-এর ‘স্টিচিং প্রিপারেশন’ রচনাটি। আলোকচিত্র ও কাঠখোদাইকে সুন্দরভাবে মিলিয়েছেন শিল্পী। পূর্বোক্ত ছবিটির সঙ্গে এই ছবিটির দ্বান্দ্বিক বৈপরীত্য আছে। ঐতিহ্য দিয়ে শিল্পী এখানে আধুনিকতাকে আঘাত করতে চেয়েছেন। দাভিদ মালাকারের চারকোলের ড্রয়িংধর্মী রচনাটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১২-টি ফ্রেমে শিল্পী এঁকেছেন নগ্নিকা মানবীর যৌনতা নিয়ে আলেখ্য। ড্রয়িং-এর বলিষ্ঠতা ও কল্পনার স্বকীয়তায় প্রচলিত অভিব্যক্তিবাদী রূপরীতিতেই স্বাতন্ত্র্য এনেছেন শিল্পী।
আমন্ত্রিত শিল্পীদের বিভাগটিতে চিত্র ও ভাস্কর্যে আধুনিকতা, আধুনিকতাবাদ ও উত্তর-আধুনিকতা — তিনটি পর্যায়েরই প্রতিফলন রয়েছে। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘সানরাইজ শান্তিনিকেতন’ কল্পনাদীপ্ত স্বাভাবিকতাবাদী রচনা। সূর্যোদয়ের লালিমায় দীপ্ত আকাশ ও তালগাছের সারি জলের উপর প্রতিফলিত হয়ে ধ্যানমগ্ন, উদার এক নিসর্গ তৈরি করেছে। সুনীল কুমার দাসের ভাস্কর্য এবং সমীর আইচ, চন্দ্র ভট্টাচার্য, আদিত্য বসাক ও অতীন বসাকের ছবিতে আধুনিকতাবাদ ও উত্তর-আধুনিক ভাবনার সমন্বয় লক্ষণীয়। কনসেপচুয়াল আর্টের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায় জনক ঝংকার নার্জারি-র কাজটি। অদৃশ্য এক সন্ত্রাসের ইঙ্গিত রয়েছে রচনাটিতে।
আমন্ত্রিত বিভাগে ছিল শক্তি বর্মন, সুহাস রায়, ভি নাগদাস, সমীর মণ্ডল, সুমন কুমার পাল প্রমুখ শিল্পীর ছবি এবং নিরঞ্জন প্রধান, গোপীনাথ রায় ও স্বপন কুমার রায়ের ভাস্কর্য।
এবার প্রদর্শনীতে সারা জীবনের কাজের জন্য সম্মানসূচক পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে শক্তি বর্মনকে। শিল্পীকে নিয়ে একটি মনোজ্ঞ নিবন্ধ লিখেছেন মনসিজ মজুমদার।