পুস্তক পরিচয় ২: বাংলাদেশের বই

একুশের চেতনায় বইমেলা অঙ্গাঙ্গি

বাংলা একাডেমি আয়োজিত একমাস ব্যাপী বইমেলা ২৯ ফেব্রুয়ারি শেষ হল। ৬৫০টি স্টল ছিল বইমেলায়, প্রকাশিত হয়েছে সাড়ে তিন হাজার বই। বিক্রির পরিমাণ ৪৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের প্রায় দ্বিগুণ। বাংলা একাডেমির গণসংযোগ বিভাগের সূত্রে এই তথ্য জানা গিয়েছে।

Advertisement
আবুল হাসনাত
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৬ ০০:০০

বাংলা একাডেমি আয়োজিত একমাস ব্যাপী বইমেলা ২৯ ফেব্রুয়ারি শেষ হল। ৬৫০টি স্টল ছিল বইমেলায়, প্রকাশিত হয়েছে সাড়ে তিন হাজার বই। বিক্রির পরিমাণ ৪৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের প্রায় দ্বিগুণ। বাংলা একাডেমির গণসংযোগ বিভাগের সূত্রে এই তথ্য জানা গিয়েছে। ২০১৫-র বইমেলার অন্তিম পর্বে মুক্তমনা লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে মৌলবাদীরা। পরে এক প্রকাশক খুন হন আজিজ সুপার মার্কেটে। আক্রান্ত হন শুদ্ধস্বর প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী। এরই প্রেক্ষিতে নাশকতার আশঙ্কা ছিল এ বারেও। তার মধ্যেও প্রকাশকরা নিষ্ঠাভরে বই প্রকাশ করেছেন, পাঠকরা সাড়া দিয়েছেন। একুশের চেতনার সঙ্গে বইমেলা অঙ্গাঙ্গি ভাবে মিশে গিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই সম্পর্কে আগ্রহ ছিল সর্বাধিক, সব থেকে বেশি বিক্রি হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের বই।

বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক, অনুবাদক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া-র লেখা জীবনীগ্রন্থ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। পাঁচশো পাতার বইটির গোড়াতেই বিশদ পরিসরে আলোচিত হয়েছে নবাবের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস। ৪১টি অধ্যায়ের শেষ কুড়িটিতে আছে পটভূমিকা সহ সিরাজউদ্দৌলার শাসন পর্বের নানা বৃত্তান্ত। পলাশির যুদ্ধের আগের ও পরের অধ্যায়গুলি পড়লে সহজেই উপলব্ধি করা যায় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে বহু প্রতিকূল পরিস্থিতি ও ষড়যন্ত্রের মধ্যে দিয়েই বাংলা শাসন করতে হয়েছে। বইটি সম্পর্কে প্রকাশকের মন্তব্যেও তারই প্রতিধ্বনি: ‘এ বইয়ের বিষয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও তাঁর বংশের প্রামাণ্য ইতিহাস।... অসাধারণ দেশপ্রেম ছিল তরুণ নবাবের। তিনি ছিলেন সরল, সহজ, বিশ্বাসী ও ধর্মপ্রাণ তরুণ। কীভাবে ইংরেজদের শঠতা, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে তিনি রাজ্য ও প্রাণ হারান এবং কীভাবে তাঁর নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো হয়, এ বইয়ে রয়েছে সেই করুণ ইতিহাস। জগৎশেঠ, দুর্লভরাম প্রমুখের সঙ্গে মিলে লোভী, ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বাসঘাতক ও রাজদ্রোহী মির জাফর আলি খান এদেশ তুলে দেন ইংরেজদের হাতে।...’ বাংলার শেষ নবাবের চরিত্র নিয়ে এক সময় কত না মন্দ কথা প্রচারিত হয়েছিল। পরে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও নিখিলনাথ রায়ের লেখা বই এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

Advertisement

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। প্রথমা, ৭০০.০০

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া গবেষকের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে তৎকালীন রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষণের পাশাপাশি বহু অজানা তথ্যেরও সমাবেশ ঘটিয়েছেন। বইমেলা চলাকালীন ২৪ ফেব্রুয়ারি ৯৭ বছর বয়সে লেখক যাকারিয়া প্রয়াত হন।

বইমেলায় প্রকাশিত আর একটি অসামান্য গ্রন্থ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত অধ্যায়/ ১৯৪৬-১৯৬৪/ পত্রপত্রিকার ভাষ্য। সংকলক সুকুমার বিশ্বাস গবেষক, ইতিপূর্বে প্রকাশিত তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ ইতিহাসের আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তিনি ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমিতে কাজে যোগ দেন এবং একাডেমির উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ ও সাক্ষাৎকার গ্রহণে যুক্ত হন। পরে তিনি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়ন প্রকল্পের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর-এর ভূমিকা বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়নে পালন করেন মুখ্য ভূমিকা। তৎকালীন সামরিক সরকার এই বইটিকে বাজেয়াপ্ত না করলেও সব মুদ্রিত গ্রন্থ বাংলা একাডেমি থেকে তুলে নেয়।

আলোচ্য বইতে যে সময়কাল বেছে নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলি তুলে ধরা হয়েছে, বাংলার রাজনীতি ও সমাজ-ইতিহাসে এই কালটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই দাঙ্গা দীর্ঘদিন লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করেছিল। দুই বাংলার মানবিকতা ও বিকাশকে শুধু বিপর্যস্ত করেনি, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ও কোটি মানুষকে ভিটেমাটি ত্যাগ করতেও বাধ্য করেছে। রাজনীতি-আশ্রিত ও নির্দেশিত এই দাঙ্গা কী কারণে ঘটেছিল তা নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষকরা এখন পর্যালোচনা করছেন। এই দাঙ্গাই বঙ্গ-বিভাজনকে ত্বরান্বিত ও অনিবার্য করে তুলেছিল। শুধু তাই নয়, উপর্যুপরি দাঙ্গা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিভেদরেখা টেনে দিয়েছে তার আজও অবসান হয়নি।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৪৬-১৯৬৪/
পত্রপত্রিকার ভাষ্য, সংকলন ও সম্পা: সুকুমার বিশ্বাস। সাহিত্য প্রকাশ, ১০০০.০০

সুকুমার বিশ্বাস সংবাদপত্রে প্রকাশিত সেই সময়ের রিপোর্টের কর্তিকা সংকলন করেছেন। কোথায় কখন কী ভাবে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে উভয় বঙ্গে তা বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে এনেছেন। এ ছাড়া দাঙ্গাবিরোধী বিবেকী কণ্ঠের প্রতিবাদী সমাবেশ, বক্তৃতা ও বিবৃতি সংকলিত হয়েছে এই বইয়ে। এই বইয়ের সহায়তা নিয়ে পরবর্তী কালে দাঙ্গা বিষয়ে আগ্রহী যে কোনও গবেষক নিশ্চয়ই উভয় বঙ্গের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট ও প্রতিবেদন থেকে গবেষণা ও সৃজনে আরও গভীর মাত্রা ও বোধ সৃষ্টি করতে পারবেন।

আরও পড়ুন
Advertisement