পুস্তক পরিচয় ১

একেই বলে স্মৃতির বিশ্বজনীনতা

প্রেসিডেন্সি কলেজে ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্টে একটি ছোটখাট নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল। লাইব্রেরিয়ান উপস্থিত না থাকলে সহ-লাইব্রেরিয়ান বিমানদা বইয়ের র‌্যাকের কাছে যেতে দিতেন, সস্নেহে নানা বিশৃঙ্খলা ও গোলমাল বরদাস্ত করে। মনে পড়ে, র‌্যাক থেকে তুলে আনছি জেমস্ মিড, হ্যারড, প্রণব বর্ধন— বইটা হয়তো ইকনমিক গ্রোথ, ডেভেলপমেন্ট অ‌্যান্ড ফরেন ট্রেড, ১৯৭১-এ ছাপা। ১৯৭৩-এ আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের কাছে তাজা বই।

Advertisement
অনিতা অগ্নিহোত্রী
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১

প্রেসিডেন্সি কলেজে ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্টে একটি ছোটখাট নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল। লাইব্রেরিয়ান উপস্থিত না থাকলে সহ-লাইব্রেরিয়ান বিমানদা বইয়ের র‌্যাকের কাছে যেতে দিতেন, সস্নেহে নানা বিশৃঙ্খলা ও গোলমাল বরদাস্ত করে। মনে পড়ে, র‌্যাক থেকে তুলে আনছি জেমস্ মিড, হ্যারড, প্রণব বর্ধন— বইটা হয়তো ইকনমিক গ্রোথ, ডেভেলপমেন্ট অ‌্যান্ড ফরেন ট্রেড, ১৯৭১-এ ছাপা। ১৯৭৩-এ আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের কাছে তাজা বই।

Advertisement

যে সময়ের কথা বলছি, তখনও প্রণব বর্ধন বার্কলে বিশ্ববিদ‌্যালয়ে যাননি। কেমব্রিজে ডক্টরেট করে কাজ করছেন দিল্লি আই এস আই-তে। উন্নয়নের অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও উন্নয়ন নীতির আর্থ-রাজনীতিতে পারদর্শিতা তরুণ বয়সেই বাংলার সন্তানকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক খ‌্যাতি ও সম্মান। ১৩টি বইয়ের লেখক, দেড়শোর বেশি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র ও ১২টি বইয়ের সম্পাদক প্রণব বর্ধনের আত্মবীক্ষণ গ্রন্থ স্মৃতিকণ্ডূয়ণ বাংলা বইয়ের তালিকায় একটি অনবদ্য সংযোজন। তিনি এমন একটি বই— স্বাদু এবং শেষ না করে ছাড়তে না-পারা গোত্রের— লিখেছেন মাতৃভাষা বাংলায়। তাঁর লেখা ঈর্ষণীয় রকমের প্রাঞ্জল, সরস এবং নিজস্ব শৈলীর ঈষৎ অন্যমনস্ক, আত্মউদাসীন কৌতুকে মোড়া। বহু অভ্যাসেও এমন সহজতা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়, অথচ প্রণব বর্ধন অতি অল্প সময়ে এবং স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় বইটি লিখে ফেলেছেন।

তৃতীয় মুদ্রণের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘উত্তর কলকাতার সংকীর্ণ গলির এক নিম্ন মধ্যবিত্ত... উৎস থেকে সারা জীবনকে একরকম নিরুত্তাপ বীতস্পৃহ খোলা চোখে দেখার রসদ পেয়েছি, জীবনের জাঁকজমকময় কিন্তু অসার প্রদর্শনীকে মোহমুক্ত ভাবে বিশ্লেষণ করার শক্তি পেয়েছি।’

লেখক বইটিকে আত্মজীবনী বা স্মৃতি-বিবরণী বলতে চাননি— তাঁর দীর্ঘ দেখাশোনার— দেশে ও বিদেশে— ‘স্মৃতির গভীর থেকে কিছু টুকরো রোমন্থনের রসে জারিত করে টুকরো টুকরো গল্পের মত করে পাঠককে পরিবেশন করা’ বলেই অভিহিত করেছেন একে। যে পরিমিতি বোধ ও সংযম বইটির সর্বাঙ্গে, লেখক তার পাঠ সম্ভবত নিয়েছিলেন শৈশবে দিদিমার চিঠির অনুলেখক হয়ে। ‘কূল ছাপিয়ে ওঠা আবেগের কথা সংক্ষেপে অথচ তার ঘনত্ব হালকা না করে কী ভাবে লিখতে হয়’ তারই হাতেখড়ি।

কিছুটা উত্তর কলকাতার আত্মীয়স্বজন পরিবৃত পরিবেশে, কিছুটা শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত স্বাধীনতায় শৈশব কেটেছে প্রণব বর্ধনের। এই অংশটুকু খুব মন-কেমন করানো। বিশেষ করে সন্ধেবেলা হারানো হাঁসের খোঁজে নদীর তীরে উদ্‌ভ্রান্ত ঘুরে বেড়ানো বালকের ছবি— এবং পরবর্তী জীবনে স্বপ্নের মধ্যে তা ফিরে আসা। আমাদের জীবনেও এমন কত বহুস্মৃত শৈশবের ছবি স্বপ্ন হয়ে ফিরে এসেছে।

কলকাতার দাঙ্গার সময়ের স্মৃতি, লুঠপাট, হনন, সৈন্যবাহিনীর মার্চ, পূর্ববাংলা থেকে আসা নিহত-পরিজন পরিচারিকার দুঃস্বপ্ন ও কান্না— সবই তাজা জেগে আছে লেখকের মনে। কিন্তু এই স্মৃতির সঙ্গে তাঁর মননে জুড়ে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ছবি— ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ইন কলর— এবং চার্লস সিমিচ-এর শঠতার সঙ্গে। স্মৃতির বিশ্বজনীনতা একেই বলে।

একটু দেরিতে, ‘যখন তখন খেলার’ পাট চুকিয়ে হিন্দু স্কুলে ভর্তি হলেন লেখক। স্কুলবেলার স্মৃতিতে যেমন আছে গৃহশিক্ষকতার ব্যবসায়িক বন্দোবস্তের অন্তর্লীন সমালোচনা, তেমন শিক্ষকদের নানা কৌতুককর কাহিনি। আছে, নিজের শিক্ষকের কাছে পাওয়া বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা। নানা ভাষার সাহিত্যে আগ্রহ তার সঙ্গে অঙ্ক আর ইতিহাসে সহজাত পারদর্শিতার সংবাদ নিজের কাছে পৌঁছে গেছে সেই বয়সেই। পরীক্ষায় ফল ভাল হত, অথচ তা নিয়ে কোনও আত্মমুগ্ধতা ছিল না— কারণ ‘পরীক্ষায় ভালো করতে যে-সব গুণ লাগে, তার সঙ্গে সৃজনশীলতার কোথাও একটা বিরোধ আছে।’ একশো পার্সেন্ট কাট্ অফ মার্কের যুগে এই স্বীকারোক্তি আর কোনও ছাত্রছাত্রীর মুখে শোনা যাবে না। যদিও তাঁর পরীক্ষাসফল মেধার সঙ্গে সৃজনশীলতার যে কোনওই বিরোধ নেই, প্রণব বর্ধনের পরবর্তী জীবনেই তা প্রমাণিত হয়েছে।

সর্বনিয়ন্ত্রক অথচ মমতাময়, সংসারী, ভোজনরসিক এবং ক্ষিদের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে তৈরি করা বাবার উদ্বিগ্নচিত্ততা লেখককে পরবর্তী জীবনেও প্রভাবিত করেছে। একই সঙ্গে বাবার লড়াকু নাস্তিকতা, শেষ জীবনের অস্থির জীবনযাপন, সর্বোপরি বাবার মৃত্যু ও সৎকারের পরের দিন রাতে বিদেশ থেকে এসে পৌঁছনোর অতন্দ্র শোক— লেখকের স্মৃতির সঙ্গে আমাদের মতো বহু স্বদেশচ্যুতকে যুক্ত করে দেয়। বাবার দুই সহপাঠী— জ্ঞানপিপাসু বিনোদ চৌধুরী ও ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’র শচীন চৌধুরী— যিনি নিজের পত্রিকায় লেখকের মেধাকে লালন করার অবাধ সুযোগ করে দিয়েছিলেন, এঁদের গভীর প্রভাব পড়েছে প্রণব বর্ধনের ভাবনায়।

তরুণ পাঠকদের কাছে বইটি আনবে এক পার হয়ে আসা সময়ের দুর্লভ স্বাদ— যা এখনকার জীবন বা ভ্রমণ বৃত্তান্তে আর পাওয়া যাবে না। উনিশশো ষাটের গোড়ার দিকের ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ ও প্যারিসের সুস্বাদু বর্ণনা আছে বইটিতে— তারই সঙ্গে নানা শিক্ষকের জীবন ও স্বভাব বৈশিষ্ট্যের অন্তরঙ্গ ছবি— জেমস মিড, বামপন্থী জোন রবিনসন, গণিতজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ফ্যাঙ্ক হান, রবার্ট সোলো, অমর্ত্য সেন। নিজের অভিজ্ঞতার গভীরতা ও বিস্তৃতির সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে দেন এই সূত্রে। অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বামপন্থার যে দ্বিচারিতা বা ভড়ং তার সম্বন্ধে প্রণব বর্ধনের স্বাভাবিক বিরাগ এই সময় থেকেই প্রকট —জোন রবিনসনের রাজনীতিবোধকে কাঁচা ও অপরিণত বলার সাহসেই তা বোঝা যায়।

প্রণব বর্ধনের শিক্ষকজীবন শুরু আমেরিকার কেমব্রিজ শহরে, এম আই টি-তে। শিক্ষকের ঈষৎ আরামদায়ক জীবনযাপন (ছাত্রজীবনের তুলনায়), সাধারণ মানুষের সারল্য, বিশ্বের ভৌগোলিক রাজনৈতিক জটিলতা সম্বন্ধে অজ্ঞতা তথা সামরিক দফতরগুলির নাগপাশ নিয়ে নানা সরস ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের পর লিখেছেন অর্থনীতি বিভাগের মধ্যমণিদের কথা। রবার্ট সোলো, পল স্যামুয়েলসন, চার্লস কিন্ডল্‌বার্গার, জোসেফ স্টিগলিটজ, পল রোজেনস্টাইন-রোডান— ছাত্রজীবনে যাঁদের বইয়ের অপেক্ষায় একাধিক বার ডিউ স্লিপ দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি, তাঁরা প্রণব বর্ধনের সহ-শিক্ষক। বিশিষ্ট ছাত্রদের মধ্যে— অবিনাশ দীক্ষিত, স্ট্যানলি ফিশার, ল্যারি সামার্স। ইজরায়েলের প্রতি পক্ষপাতের নিগড়ে কেবল মার্কিন রাষ্ট্রনীতি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রসনাও আবদ্ধ, এমন নির্মম তথ্য খুবই অনুত্তেজিত ভাবে পরিবেশন করেছেন।

অর্থনীতিতে বৈদগ্ধ্য প্রণব বর্ধনকে জীবনবিমুখ তো করেইনি, বরং কলকাতার গলি ও শান্তিনিকেতনের প্রান্তরে উন্মুক্ত শৈশব, মাতামহী ও পিতার ঈষৎ প্রথাবিরোধী জীবনরুচি তাঁর মধ্যে সর্বদা সঞ্চারিত রেখেছে গভীর মানবিকতার বোধ ও প্রান্তিক জীবনের প্রতি সহমর্মিতা। নিজের সাম্প্রতিক গবেষণাতেও সমাজের প্রান্তিক বর্গ, তাদের জীবন-জীবিকার প্রতি গাঢ় অভিনিবেশ— তাঁর বিশ্বসাহিত্য ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের প্রতি নিবিড় আকর্ষণেরই বিপরীত পিঠ।

যাঁরা কর্মসূত্রে বিদেশে থাকেন ও মাঝে মাঝে মধ্যবর্তী মহাদেশ ও সমুদ্র সকল আকাশপথে পারাপার করেন, তাঁদের মধ্যে প্রায়শই দেশ-বিদেশের মধ্যে দোলাচলচিত্ততা দেখা যায়। প্রণব বর্ধনের ক্ষেত্রে নিয়মিত ভারতবর্ষে আসা তাঁর সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত। আই এস আই-তে থাকাকালীন টি এন শ্রীনিবাসন ও অশোক রুদ্রের সঙ্গে তাঁর যে সখ্য গড়ে উঠেছিল, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অর্থনীতির পুনঃসমীক্ষার কাজে তা নবায়িত হয়েছে। কেবল অর্থনীতির বীক্ষণে বিশ্লেষণকে সীমাবদ্ধ না রেখে লেখক ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজনীতি ও সাহিত্য থেকেও দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র আহরণ করেছেন। এই দেখার গভীরতা ও বিস্তারই ভারতবর্ষের মানুষের সঙ্গে তাঁর অন্বয়ের অবিচ্ছিন্ন সূত্র।

তবুও প্রথম প্রজন্মের প্রবাসীর ‘মধ্যবর্তী শূন্যতার’ অনুভূতি লেখকের মনকে ছেড়ে যায় না। এক দিকে সদাব্যস্ত সদা আমন্ত্রিত বিশ্বনাগরিকের জীবন, অন্য দিকে দেশের জীবনের বিপন্ন অস্থিরতার বেদনা তাঁর চিরসঙ্গী। শত ছিদ্র না হলে বুঝি জীবনের সংগীত বেজে ওঠে না।

সর্বাঙ্গসুন্দর এই বইটির দু’টি বিষয় নিয়ে আমার ঈষৎ অসম্পূর্ণতার বোধ। প্রথমটি হল, বইয়ের নামকরণের পিছনে যদিও মৃদু কৌতুক সৃষ্টিই লেখকের উদ্দেশ্য, ভাষার গভীর জ্ঞান সত্ত্বেও তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে যে, স্মৃতি ও কণ্ডূয়ণ শব্দ দু’টি পরস্পরে স্বাভাবিক ভাবে অন্বিত নয়, এবং শ্রবণে গুরুচণ্ডাল প্রতীত হয়। ভিতরের প্রচ্ছদে ইংরাজি অনুবাদে ‘Memory scraching’-এর প্রয়োগও ততটাই শ্রুতিকটু।

দ্বিতীয়ত, লেখকের জীবনসঙ্গী শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ কল্পনা বর্ধন, যাঁর বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ ও সম্পাদনা আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছে, তাঁর গুণাবলির বিষয়ে (সম্ভবত লজ্জাশীল) অনুল্লেখ।

আরও পড়ুন
Advertisement