পুস্তক পরিচয় ১

উৎসের খোঁজে তাঁর দৃষ্টি মৃত্তিকার গভীরে

বাঙালির সত্তা পরিচয়ের দু’টি আধার। একটি তার মাতৃভাষার ইতিহাস, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘ও ডি বি এল’, অপরটি ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’, গড়ে গিয়েছেন সুনীতিবাবুর ‘চ্যালা’ সুকুমার সেন। সুনীতিবাবুর গবেষণা রীতিমতো অ্যাকাডেমিক শৃঙ্খলায়, বিলেতে, অধ্যাপক ফ্রেডারিক উইলিয়ম টমাসের তত্ত্বাবধানে।

Advertisement
সত্যজিৎ চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৬ ০০:০০

বাঙালির সত্তা পরিচয়ের দু’টি আধার। একটি তার মাতৃভাষার ইতিহাস, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘ও ডি বি এল’, অপরটি ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’, গড়ে গিয়েছেন সুনীতিবাবুর ‘চ্যালা’ সুকুমার সেন। সুনীতিবাবুর গবেষণা রীতিমতো অ্যাকাডেমিক শৃঙ্খলায়, বিলেতে, অধ্যাপক ফ্রেডারিক উইলিয়ম টমাসের তত্ত্বাবধানে। সুকুমার সেন অমন কোনও বাঁধাধরা পথে গবেষণায় প্রবৃত্ত হননি। কারও পরিচালনায় নয়, বিদ্যাজগতে তাঁর আত্মবিকাশ নিজেরই উদ্ভাবিত পথে। এক বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে, ইচ্ছাসুখে কাজ করে গিয়েছেন। তাঁর নিজের কথা, ‘আমি তো কখনো থেমে থাকিনি, নিজের মনে কাজ করে চলেছি।’ কথাটায় প্রকাশ পায় প্রগাঢ় দায়িত্ব চেতনা, দায়িত্ব নিজের প্রতি এবং বিদ্যাজগতের প্রতি। রচনাবলির বিপুলতা এবং বিষয় বৈচিত্রে তিনি এর প্রমাণ রেখে গিয়েছেন। এ সম্ভারের খতিয়ান করতে গেলে মনে হয় মননী প্রতিভাও সৃজনশীল হতে পারে। কবির মতো, শিল্পীর মতো চিন্তাবিদও আত্মপ্রকাশের জন্য নিরন্তর ভাবাশ্রয় উদ্ভাবন করে চলেন। সুকুমার সেনের রচনাসম্ভার এমন সৃজনী-মনীষার এক উজ্জ্বল নজির। এই সম্পদ গুছিয়ে স্থায়ী ভাবে রাখার জন্য আনন্দ সম্পূর্ণ প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করতে বেশ কয়েকটি খণ্ড দরকার হবে। কাজটি পরিচালিত হচ্ছে অধ্যাপক সুনন্দন সেনের সম্পাদনায়। সুনন্দন প্রয়াত সুকুমার সেনের পৌত্র। কঠিন এ দায়িত্ব তিনি সযত্নে পালন করতে পারবেন আমরা আশা করব।

এত বড় কাজে নির্দিষ্ট একটা পদ্ধতি ধরে এগোনো দরকার। সম্পাদক জানাচ্ছেন, ‘প্রাথমিক ভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে খণ্ডে খণ্ডে প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করা হবে। সেইভাবে সংগৃহীত প্রবন্ধগুলিকে প্রথমে বিষয়ভিত্তিক সাজানো হয়েছে। তারপর এক-একটি বিষয়ের প্রবন্ধগুলিকে যথাসম্ভব কালানুক্রমিক ভাবে সাজানো হয়েছে, তবে তথ্যের অভাবে সর্বত্র তা সম্ভব হয়নি’। সংকলিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৭৫। সাজানো হয়েছে পাঁচটি থাকে: ১। শব্দবিদ্যা ও ভাষাতত্ত্ব, ২। সংস্কৃত সাহিত্য, ৩। বাংলা সাহিত্য (প্রাগাধুনিক যুগ), ৪। সংস্কৃতি, ৫। লোক সাহিত্য।

Advertisement

সুকুমার সেনের লেখা প্রবন্ধের মোট সংখ্যা কত হতে পারে? অনুমান করে নেওয়া হয়েছে আড়াইশো। সংখ্যাটা বাড়বে নিশ্চিত। কোনও প্রার্থীকেই তিনি ফেরাতেন না। লেখা দেওয়ার দিনক্ষণ বলে দিতেন। প্রার্থী সময়মত এসে দাঁড়ালেই দেরাজ খুলে লেখাটি হাতে তুলে দিয়ে শুধু বলতেন ‘ছাপা হলে আমায় একটা কপি দেবেন, আমি কোনও কপি রাখিনি’। ছোট-বড় কত পত্রিকার অনুরোধ। সাহস করে কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাতে পারলে লেখা পাওয়া নিশ্চিত। খুব মনে পড়ে, মাঝেমধ্যে ওঁর হাতে-লেখা দু’-চার লাইনের পোস্ট কার্ড পেতাম। কোনও খুদে কাগজের সম্পাদকের নাম করে টেকচাঁদি ভাষায় লিখছেন, ‘সে যে দস্তে এল এল, পেলিয়ে যায়! তোমাদের ওদিকেই থাকে বলেছিল। ধরা কি সম্ভব।’ হন্যে হয়ে খুঁজে সে সম্পাদকের পাত্তা পাওয়া যেত না অনেক সময়। কত জনের বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। অনেক স্মারক সংকলনের জন্য ছোট-বড় লেখা তৈরি করে দিয়েছেন। সারা জীবনের এত উজ্জ্বল ফসল যে গোলায় তুলতে পণ করবে, তাও সারা জীবনের কাজ। তরুণ সম্পাদকের উদ্যমে সবাই সুবাতাস দেবেন নিশ্চয়।

প্রস্তুত সংকলনটিতে হাতে পাচ্ছি পাঁচ থাকে সাজানো ৭৫টি লেখা। সুকুমারবাবু তৌলন ভাষাতত্ত্বের বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত, কিন্তু তাঁর রচনাধারায় বাক্‌তত্ত্ব একচেটে বিষয় নয়। মানব-সংস্কৃতির নানান প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছেন এবং কিছু-না-কিছু মৌলিক অবলোকনে প্রসঙ্গটিকে প্রদীপ্ত করে তুলেছেন। তাঁর বলার ধরনটি শ্রুতিরোচন, গল্পরসে জারানো। রচনাশৈলীর স্বচ্ছন্দ প্রবাহের জন্য গুরুতর বিষয়ের প্রবন্ধও ভারমুক্ত আন্তরিক হয়ে ওঠে। যেমন তাঁর বিশেষজ্ঞতার এলাকার একটি মূল্যবান লেখা ‘বাংলা শব্দবিদ্যার শিশুবোধক’, বেঁচে থাকতে প্রকাশ করেননি। লেখাটির উদ্দেশ্য জটিল বিষয়টিতে জিজ্ঞাসুর জন্য পথনির্দেশ, ভয় কাটিয়ে হাত ধরে নিয়ে যাওয়া, সঙ্গে নিজেরই কিছু সিদ্ধান্তের পুনর্বিচার। প্রখর যুক্তিবাদী আধুনিক মনের এই মনীষীর সতর্ক দৃষ্টিতে অপরের রচনার ত্রুটি-বিচ্যুতি যেমন, তেমনই নিজের রচনার ভুলচুকও এড়ায় না এবং নিজেকে সংশোধন করে চলতে কোনও দ্বিধা বা লজ্জা নেই। কোনও বিষয়ে আগে পরে লেখা প্রবন্ধ কালানুক্রমে সাজিয়ে দেখলে সুকুমারবাবুর মননপদ্ধতি চমৎকার ধরা যায়। যেমন ব্রজবুলি ভাষা নিয়ে তাঁর বিভিন্ন বয়সের লেখা। এই সংকলনেই তার কিছু নজির আছে।

বিষয় যা-ই হোক, সর্বত্র তাঁর চিন্তার চলন ইতিহাসের পথে। প্রবন্ধগুলির মধ্যে গাঁথনি ইতিহাসবোধের সুতোয়। গৌণ বিষয়ও দেখেন এবং দেখান ইতিহাসের ফ্রেমে। প্রায়ই সাম্প্রতিক থেকে দৃষ্টি যায় ঋগ্বেদের ধূসর জগতে বা আরও দূরে আর্য-পূর্ব বা প্রত্ন-আর্য ভারতে। সজাগ রাখেন এই বোধ যে, ভারতের সাংস্কৃতিক পরম্পরা, যা বহু শতাব্দী পেরিয়ে এ কাল ছুঁয়েছে তা অবিচ্ছিন্ন, তার শিকড় আছে দূর অতীতের অজ্ঞাত কোনও লোকসংস্কৃতির জমিতে।

সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর একটি গুরুতর প্রণিধান, ‘যাকে আমরা মানি সাধারণ সাহিত্য বলে, অর্থাৎ বিদগ্ধ সাহিত্য, তার প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে ভূমিগর্ভে, লোকসাহিত্যের ভিত্তিপ্রস্তরের ওপরে। লোক-সাহিত্যের বীজ থেকেই বিদগ্ধ সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ।’ লোক-সাহিত্যের মূল্যগৌরব প্রথম নির্ধারণ করেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে সুকুমার সেন বিশ্লেষণ করেছেন এই বইয়ে সংকলিত আটটি প্রবন্ধে। ‘ছেলেমি’ ছড়া-গান-কথা মিলিয়ে চিরসজীব সম্ভারটিকে নাম দিয়েছেন ‘শিশু-বেদ’। ‘‘শিশু-বেদ হল মানুষের আদিম সাহিত্য যা পরবর্তী সাহিত্যের— কোন ভাষায় কিছু উদ্ভূত হয়ে থাকলে— বীজ’’। রবীন্দ্রনাথের পরে আর কেউ লোকসাহিত্যকে এমন অমোঘ গৌরব দেননি। ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে লোকসংস্কৃতি চর্চার খুব রমরমা, তার প্রায় সবই নৃতত্ত্বের অনুগামী গবেষণা, আদ্যিকালের ভেরিয়র এলুইনের হাত ধরা। কোনও নতুন পদ্ধতিবিজ্ঞান, মেথডলজি উদ্ভাবনের মৌলিকতা নেই। সুকুমার সেন এগিয়েছেন ভিন্ন পথে। সাহিত্য-সংস্কৃতির বিদগ্ধ রূপটি গড়ে ওঠে লোকজীবনের সজীব-সম্পন্ন ভিতের উপর। পরিশীলিত আধুনিক যাবতীয় সৃষ্টির শিকড় আছে সেই আদিম লোকরুচির বাস্তবে। শব্দবিদ্যায় হোক বা সাহিত্যের ইতিহাস নির্মাণে হোক, উৎসসন্ধানে সুকুমার সেনের দৃষ্টি যায় সেই আদি মৃত্তিকার গভীরে। এ ভাবে দেখার দৃষ্টি তিনি পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে। অপৌরুষেয় ‘ছড়ায়’ ‘গানে’ ‘কথায়’ কোথায় কেমন করে কবিত্বের মাধুর্য ফোটে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন। সে দৃষ্টির প্রসারিত প্রয়োগ সুকুমার সেনের অবলোকনে একটা যুক্তিযুক্ত পদ্ধতিবিজ্ঞানের মর্যাদা পেয়েছে।

আরও পড়ুন
Advertisement