চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

উঠে আসে প্রবহমান জীবনের বিপন্ন করুণার রূপ

‘গ্যালারি এম’-এ অনুষ্ঠিত সম্মেলক প্রদর্শনী দেখে এলেন মৃণাল ঘোষশিল্পকলা সব সময়েই অস্তিত্বকে বিশ্লেষণ করে। সেই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলে এক বিকল্প ‘প্রকৃতি’। কখনও তা ভালবাসার বার্তা আনে। কখনও সংঘাতের। সেই বার্তার ভাষা পাল্টায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। সময়ের জটিলতা অস্তিত্বে প্রতিফলিত হয়। অস্তিত্বের বিশ্লেষণ থেকে তা নেমে আসে চিত্রপটে। অথবা ভাস্কর্য বা ইনস্টলেশনের ত্রিমাত্রিকতায়। ‘গ্যালারি এম’-এ অনুষ্ঠিত সম্মেলক প্রদর্শনী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১

শিল্পকলা সব সময়েই অস্তিত্বকে বিশ্লেষণ করে। সেই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলে এক বিকল্প ‘প্রকৃতি’। কখনও তা ভালবাসার বার্তা আনে। কখনও সংঘাতের। সেই বার্তার ভাষা পাল্টায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। সময়ের জটিলতা অস্তিত্বে প্রতিফলিত হয়। অস্তিত্বের বিশ্লেষণ থেকে তা নেমে আসে চিত্রপটে। অথবা ভাস্কর্য বা ইনস্টলেশনের ত্রিমাত্রিকতায়। এখন আমাদের দেশে যে বিপুল কর্মোদ্যোগ চলছে, তাতে অতীতের পুনরাবৃত্তি যেমন আছে, তেমনই সৃষ্টি হচ্ছে সাম্প্রতিকের অস্তিত্ব-বিশ্লেষণের স্বতন্ত্র ভাষাও।

কলকাতায় আরও একটি নতুন আর্ট-গ্যালারি খুলল ‘মেট্রিক্স ইন্টারন্যাশনাল অব একসেলেন্স’ সংস্থার উদ্যোগে নন্দলাল বসু সরণিতে, যার নাম ‘গ্যালারি এম’। এই গ্যালারির উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি ১৬ জন শিল্পীর সম্মেলক দিয়ে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘এক্সিস্টেনশিয়াল এক্স্‌প্লোরেশনস্‌’। একবিংশ শতকের বিশ্বায়িত জটিল কাল-পরিস্থিতিতে শিল্পীরা বিশ্লেষণ করেছেন এই সময়কে। সেই বিশ্লেষণের ভাষা এই সময়কে চিনতে সাহায্য করে। দৃশ্যকলায় সব সময়ই ‘রূপ’-ই ভাবনা বা বিষয়ের স্মারক। প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা করেছেন তরুণী গবেষক পরমা মাইতি।

Advertisement

শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভাস্কর্যের অধ্যপক পঙ্কজ পাঁওয়ার-এর একটি ব্রোঞ্জ-ভাস্কর্যের শিরোনাম ‘হামারা বাজাজ চেতক’। পথ দিয়ে মোটরবাইকে যাচ্ছে যুবক-যুবতী। রাত্রিবেলা। সামনে পড়েছে আয়তনময় শঙ্কুসদৃশ আলোর বিম্ব, পিছনে পুঞ্জীভূত দূষিত কার্বনের ধোঁয়া। আলোকবিম্বের সঙ্গেই মিশে রয়েছে দূষণের বিষ।এই হল আজকের সভ্যতার এক খণ্ডচিত্র।

প্রশান্ত সাহু-র ছাপচিত্রের সঙ্গে সমন্বিত ফাইবারগ্লাস, প্লাস্টারের ভাস্কর্য ‘হোমেজ টু অ্যান আননোন সোলজার’। একটি নকল পা নির্মিত হচ্ছে। যন্ত্রপাতি, চিত্ররূপ রয়েছে পাশে। যুদ্ধ যে বিপর্যয় ডেকে আনে তারই এক প্রতীক যেন। প্রদীপ পাত্রের ফাইবার গ্লাস ও কাঠের রচনা ‘পালঙ্ক’। অতীতের স্মৃতি যেন ফসিল হয়ে আছে আজকের বিপর্যস্ত সময়ে। দেবজিত্‌ চক্রবর্তীর সিরামিক ও লোহার তৈরি মুখাবয়ব ভাস্কর্যটির শিরোনাম ‘মহাকাল’। আজকের অস্তিত্বে সংলগ্ন হয়ে মহাকালও যেন শঙ্কাকুল।

চন্দ্র ভট্টাচার্যের অ্যাক্রিলিকে আঁকা ক্যানভাসটিতে উপস্থাপিত প্রতিমাকল্প আপাতভাবে খুবই সহজ। ঝুলন্ত একটি ফুলের গুচ্ছের দিকে তাকিয়ে আছে একটি মেয়ে। কিন্তু সারল্যের ভিতরই অন্তর্লীন থেকে যায় গহন এক সংকট, এই সময়ের কালিমা। উষ্মিতা সাহুর ‘কোলামস্‌ অব লাইট’ চিত্রমালার অন্তর্গত একটি অনামা ছবি রয়েছে কাগজের উপর অ্যাক্রিলিক ও গ্রাফাইটে আঁকা। বিপুল এক আরোপিত বিমূর্ত পরিসরের উপর এক ঝলক আলো যেন ধূম্রজালের মতো শরীর পেয়েছে। আত্মপরিচয়হীনতার সংকটে ভাসছে সেই বিমূর্ত বিম্ব। নবীনা গুপ্তার অ্যালুমিনিয়াম ও অ্যাক্রিলিকে রূপারোপিত ‘অনন্ত্‌’ শীর্ষক রচনাটিতে একটি অচেনা প্রাণীর ফসিলের আভাস। সেই বিলয়ের ভিতর জীবনের সূক্ষ্ম অনন্ত বীজমালা সঞ্চরণ করছে। পম্পা পাঁওয়ার-এর ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিক ও বালির প্রলেপে আঁকা রচনাটির শিরোনাম ‘অন দ্য আদার সাইড অব টাইম’। কালপ্রবাহের প্রতীক যেন এক কল্পিত নদী। তার এক প্রান্তে ভাসছে শৈশবের স্বপ্ন কাগজের নৌকা। অপর প্রান্তে সার সার দাঁড়িয়ে আছে বাস্তবের জেলেডিঙি।

জয়শ্রী বসাক এচিং ও ভিসকসিটির সঙ্গে সুতোর কাজকে মিলিয়েছেন সুন্দর ভাবে তাঁর ‘দ্য উইকএন্ড’ শীর্ষক রচনাটিতে। কাঁথাশিল্পের লৌকিকের মধ্য দিয়ে মিলিয়েছেন শৈশবের স্বপ্ন। জলের ভিতর মাছেদের খেলা আর ধোঁয়া উড়িয়ে খেলনা ট্রেনের ছুটে যাওয়া। মহজবিন মজুমদার-এর অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাস ‘স্লো ল্যামেন্ট’-এ রূপায়িত হয়েছে জীবনের ভিতর জীবন। উপরের সেই অলঙ্কৃত জীবনের সংবৃত দুঃখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে বিপর্যস্ত এক মানবীর উচ্চকিত আর্তনাদ। অলঙ্করণ প্রবণতার ভিতর দিয়েই আদর্শ ও বাস্তবকে মিলিয়েছেন শিল্পী। অর্পণ মুখোপাধ্যায়ের ‘অ্যাফিনিটি’ শীর্ষক আলোকচিত্রমালায় প্রবহমান জীবনের বিপন্ন করুণার দৃশ্যরূপ উঠে এসেছে।

প্রদর্শনীতে এ ছাড়াও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন অমিতেশ শ্রীবাস্তব, ধরিত্রী বোরো, মৌটুসি চক্রবর্তী, শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরজিত্‌ বিশ্বাস।

আরও পড়ুন
Advertisement