চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

আলো-ছায়ায় বাস্তবের অন্তর্লীন রহস্য

বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত সুমিত বসুর আলোকচিত্র প্রদর্শনীটি দেখলেন মৃণাল ঘোষ। সুমিত বসুর আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী চলছে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। এই বর্ষীয়ান শিল্পী পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। আলোকচিত্র তাঁর ভালবাসা ও সাধনার জায়গা। দীর্ঘদিন ছবি তুলছেন। ২০০০ সালে মুম্বইতে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল। তার পর থেকে বহু প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। সম্মানও পেয়েছেন। প্রায় ৪০-টি সাদা-কালো ছবি নিয়ে আয়োজিত এ বারের এই দ্বাদশ একক প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘হিয়ার অ্যান্ড নাউ’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৬ ০০:০০

সুমিত বসুর আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী চলছে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। এই বর্ষীয়ান শিল্পী পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। আলোকচিত্র তাঁর ভালবাসা ও সাধনার জায়গা। দীর্ঘদিন ছবি তুলছেন। ২০০০ সালে মুম্বইতে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল। তার পর থেকে বহু প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। সম্মানও পেয়েছেন। প্রায় ৪০-টি সাদা-কালো ছবি নিয়ে আয়োজিত এ বারের এই দ্বাদশ একক প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘হিয়ার অ্যান্ড নাউ’।

আজকের ডিজিটাল ফোটোগ্রাফির যুগেও সুমিতবাবু আলোকচিত্রের প্রাক্তন পদ্ধতিকেই অনেক সৃজনশীল মনে করেন, যেখানে বৈদ্যুতিন নির্ভরতার পরিবর্তে শিল্পীর আত্মগত বোধ ও অভিজ্ঞতাকে অনেক বেশি কাজে লাগানো যায়। প্রকৃতি বর্ণময়। বর্ণের সেই বৈচিত্রকে ছবিতে ধরা যায় সহজেই। তাতে স্বাভাবিকতার অনুরণন আসে। বাস্তব ও শিল্পের মধ্যে ব্যবধান অনেক কমে যায়। কিন্তু দৃশ্যকলা তো প্রাকৃতিক বাস্তব নয়। বরং প্রকৃতির সমান্তরালে স্বতন্ত্র এক বাস্তবের নির্মাণ। যে নির্মাণের মধ্য দিয়ে সত্যের নানা মাত্রা ও আভাসকে অনুধাবন করতে চান শিল্পী। সে দিক থেকে আলোকচিত্রে বর্ণের বৈচিত্রকে পরিহার করে শুধু মাত্র বর্ণমালার দুই চরম প্রান্তকে আশ্রয় করেন যখন শিল্পী সাদা-কালোর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন, তখন তিনি প্রাকৃতিক বাস্তব থেকে সরে যান। বলা যেতে পারে খানিকটা বিমূর্তের কাছাকাছি আসেন। সাদা হচ্ছে পূর্ণ আলো। কালো হচ্ছে পূর্ণ আঁধার। এই দুইয়ের মধ্যে থাকে ধূসরের অন্তহীন স্তর। ধূসরের সেই বিস্তীর্ণ মাত্রাকে প্রকৃষ্ট ব্যবহার করতে পারলে নানাবিধ রহস্যকে উদ্ঘাটিত করা যায়। সুমিত বসু সাদা-কালোতে কাজ করতে পছন্দ করেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ছবিতে ধূসর নানা ভাবে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।

Advertisement

আজকের আলোকচিত্রে প্রকাশের নানা বৈচিত্র রয়েছে। মূর্ত থেকে বিমূর্তের অনেকগুলি স্তর নিয়ে কাজ হয় সেখানে। অনেক শিল্পী আছেন যাঁরা ক্যামেরাকে ব্যবহার করেন রং-তুলির বিকল্প হিসেবে। আলোকচিত্র তাঁদের হাতে হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ চিত্রপ্রতিম। আবার আপাত বাস্তবকে নিয়ে কাজ করতে করতে অনেক শিল্পী বাস্তবের অন্তর্লোকে প্রবেশ করে তার নিহিত রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেন।

সুমিত বসুকে বলা যেতে পারে এই দ্বিতীয় ধারার শিল্পী। দৃশ্য-বাস্তবকে নিয়ে কাজ করতে করতে তিনি সেই দৃশ্যের গভীরে প্রবেশ করেন। এই প্রদর্শনীর ছবিগুলির অধিকাংশের ভিতরই জ্যামিতিক নির্মাণ লক্ষ করা যায়।

শিল্পী: সুমিত বসু

‘গার্ডেন অব ইডেন’ শীর্ষক ছবিতে চিত্রপটকে উপরে-নীচে দুটি ভাগে বিভাজিত হতে দেখা যায়। উপরে রয়েছে কয়েকটি অট্টালিকা। তাদের দৃঢ়বদ্ধ কৌণিক জ্যামিতির সঙ্গে উপরে মেঘাবৃত আকাশের উদার ব্যাপ্তি বিশেষ এক নান্দনিক দ্বৈত তৈরি করে। এখানেই আলো-ছায়ার দ্বান্দ্বিকতার সঙ্গে ধূসরের নিহিত সুরের অনুরণনও লক্ষণীয়। নিম্নবর্তী অংশে যে প্রকৃতি, কয়েকটি গাছ ও পশ্চাৎবর্তী দেওয়ালের উপর রোদের ঝলক, ছায়াবৃত নিম্নাংশে একটি রাজহাঁসের নীরব উপস্থিতি— সবটা মিলে বাস্তবের অন্তর্লীন এক রহস্য উদ্ঘাটিত হয়।

‘মারোয়াড়ি হাউজ’ শীর্ষক ছবিটিতেও কয়েক-তল বিশিষ্ট অট্টালিকার উপস্থাপনা আর মাঝখানে উঠোনের শূন্য পরিসর। জ্যামিতির বিচিত্র কারুকাজ এখানেও ‘টেরেস গার্ডেন’-এ একটি চতুষ্কোণ পরিসরের পরিব্যাপ্ত শূন্যতার মধ্যে আলো দিয়ে যে ছায়া রচিত হয়, তারই এক অব্যক্ত রহস্য ধরা পড়ে।

‘বুলা বাবুজ ম্যানসন’ ছবিতে পরিসরের জ্যামিতি ও শূন্যের জ্যামিতির মধ্যে নীরব সংলাপ রচিত হয়েছে। জ্যামিতিক সৌকর্যের অসামান্য নিদর্শন এই ছবিটি।

এই রকম সব দৃশ্যাবলি অতিক্রম করে আমরা ভূমিতে পড়ে থাকা একটি মৃত পাখিতে এসে পৌঁছই। শিরোনাম ‘ডেড পন্ড হেরন’। সহসা নিবিড় তমসার এক ‘বেহাগ’ যেন বেজে ওঠে। মৃত পাখির বুকের কাছে আলোর উজ্জ্বলতা। সমস্ত শরীরে বিচ্ছুরিত ছায়া। যে চতুষ্কোণ পরিসরে পড়ে আছে এই মৃত পাখি তার ধূসরতার সঙ্গে আলোর বুনোটের দ্বৈত এই মৃত্যুকে আরও প্রগাঢ় বেদনায় জারিত করে তোলে। তাৎক্ষণিকের (হিয়ার অ্যান্ড নাউ) ভিতর দিয়ে এ ভাবেই শিল্পী অন্তহীনের বার্তা আনেন।

আরও পড়ুন
Advertisement