পুস্তক পরিচয় ২

‘আমাদেরও সিনেমা দেখার চোখ ফুটল’

চলচ্চিত্র নিয়ে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের গদ্যে যেটা লক্ষ করার মতো— তাঁর রচনা শিল্পরূপের বিচার করতে-করতে স্বতন্ত্র সাহিত্যকর্ম তো হয়ে ওঠেই, সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-মূল্যায়নটিকে নৈতিক বিবেচনায় নিষিক্ত করে। তাঁর সঙ্গে মতদ্বৈধতায় গেলেও পাঠকের কাছে তাঁর যুক্তির জাদু, ব্যতিক্রমী বাক্যবন্ধ প্রায় অপ্রতিরোধ্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৪ ০০:০২

চলচ্চিত্র নিয়ে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের গদ্যে যেটা লক্ষ করার মতো— তাঁর রচনা শিল্পরূপের বিচার করতে-করতে স্বতন্ত্র সাহিত্যকর্ম তো হয়ে ওঠেই, সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-মূল্যায়নটিকে নৈতিক বিবেচনায় নিষিক্ত করে। তাঁর সঙ্গে মতদ্বৈধতায় গেলেও পাঠকের কাছে তাঁর যুক্তির জাদু, ব্যতিক্রমী বাক্যবন্ধ প্রায় অপ্রতিরোধ্য। চল্লিশ বছরের একটু কম ব্যবধানে লেখা সত্যজিৎ-সংক্রান্ত দু’টি নিবন্ধই ধরা যাক। ১৯৭৩-এ ‘অশনি সংকেত’ বেরনোর পর উত্তপ্ত হয়ে সিনেমা নিয়ে সঞ্জয়ের প্রথম রচনা ‘রোমান্টিক মন্বন্তর বনাম হাঘরে রোমান্টিকতা’, তাতে লিখছেন, ‘পৃথিবী নামের এই গ্রহ যে সত্যজিৎবাবুকে সম্মানিত করতে পেরেছে, এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবু অশনি সঙ্কেত দেখে কেন যে মনে হয় ভিক্টিমাইজ্ড হওয়ার প্রয়োজন বোধহয় আছে। গোল্ডেন বিয়ারের প্রতি আমার অভিযোগ নয়; অভিযোগ যে স্বদেশে অন্ধ স্তব ও বিদেশে পুরস্কার তাঁকে নিজস্ব রক্তপরীক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।’ আবার ২০১১-য় ‘আড়ালের রাজনীতি এবং সত্যজিৎ রায়’ নামাঙ্কিত নিবন্ধে ‘অপুর সংসার’ আর ‘জনঅরণ্য’-এর সাযুজ্যে লিখছেন ‘যে অপু ষাট দশকের শুরুতে অধ্যক্ষের ঘরের বাইরে ছাত্র আন্দোলনের স্লোগান শুনেছিল সে আজ দেখতে পায় দেওয়াল-লেখায় মাও সে-তুঙের স্টেনসিল কীভাবে এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এরকম স্মৃতি মনে আসলে সত্যিই অনুতাপ হয়, কেন যে সাবেকি ঘরানার চিন্তার দাপটে আমরা সুকুমার-তনয়কে অরাজনৈতিক ভেবে বসলাম!’ নিবন্ধ দু’টির বিরোধাভাস স্পষ্ট করে দেয় লেখক তাঁর রাজনৈতিক মন নিয়েই সত্যজিৎ-অন্বেষণ করে চলেন।

তবে এই খোঁজার মধ্যে মিশে থাকে শিল্প হিসেবে সিনেমার রহস্য অনুসন্ধানও। না হলে ভারতীয় সিনেমার প্রেক্ষিতে ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির অর্ধশতকে (২০০৫) তিনি নিজের নিবন্ধের নাম দিতেন না ‘বিস্ময়ের পঞ্চাশ বছর’। লিখছেন: ‘‘পথের পাঁচালী’তে যখন অপু পাঠশালায় যাওয়ার জন্য চোখ মেলল, আমাদেরও সিনেমা দেখার চোখ ফুটল।’ সিনেমার রহস্যের সঙ্গে তার স্বাদেশিকতা-আন্তর্জাতিকতাকেও বাঙালি সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য গ্রন্থি করে তোলেন সঞ্জয়। তাই তাঁর এই অনভিজাতদের জন্য অপেরা-র (প্রতিভাস, ৪৫০.০০) নিবন্ধাদি ‘এপার’ এবং ‘ওপার’ দু’ভাগে সাজানো। এপার-এ ‘মৃণাল সেন: ইতিহাসের মাত্রা’ বা ‘ওগো, শোনো কে বাজায়: বাঙালির সৌমিত্র’র মতো রচনার সঙ্গেই রয়েছে আবার ‘ছায়াছবির কারুবাসনা: অজয় কর’ বা ‘উত্তমআলেখ্য’র মতো রচনা। দেবকীকুমার বসু, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী-সহ বাংলা ছবির কমেডিয়ানরা, সুব্রত মিত্র, গুরু দত্ত, ‘কল্পনা’-র স্রষ্টা উদয়শঙ্কর— কেউই বাদ পড়েননি লেখকের স্বদেশ-অভিজ্ঞান থেকে। আর ‘ওপার’-এ তাঁর রচনায় বুনুয়েল, আন্তোনিওনি, ত্রুফো, অরসন ওয়েলস, বাস্টার কীটন, কুরোসাওয়া, বার্গমান, তারেক মাসুদ থেকে তারকোভস্কি অবধি কে নেই! তবে তাঁর গোদার-মুগ্ধতা চোখে পড়ার মতো, একটি রচনার নামই ‘হলিউডের প্রার্থনা গোদারের উত্তর’, তাতে লিখছেন ‘হলিউডের গায়ত্রীমন্ত্র যে স্বচ্ছতা তিনি তার থেকে দূরে; একাকী ও অনমনীয়।’

Advertisement

সঞ্জয় সেই বিরল বাঙালি, দীর্ঘকাল যিনি ঋত্বিক-চর্চাকারী। সত্তর দশকে ঋত্বিক ঘটকের প্রয়াণের পর তাঁর লেখা ঋত্বিকতন্ত্রও নতুন কলেবরে বেরল (সপ্তর্ষি, ১৫০.০০)। এতে যোগ হয়েছে লেখকের পরবর্তী কালের রচনাগুলি, তাতে তাঁর ঋত্বিক-সংক্রান্ত চিন্তাও যে কোনও অনড় পটভূমিতে দাঁড়িয়ে নেই, কবুল করেছেন প্রাককথন-এ: “একদা যাঁকে আমার রবীন্দ্র-চেতনার প্রতিপক্ষ মনে হয়েছিল ক্রমশ উপলব্ধিতে আসে প্রতিসাংস্কৃতিক বিকল্পের খোঁজে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই বিরতিহীন সংলাপ বিনিময় করে গেছেন। তিনি নাশকতার দেবদূত ঠিকই কিন্তু চলচ্চিত্রের মতো জনচিত্তহারী মাধ্যমকে হয়তো ঋত্বিকই এই উপমহাদেশে প্রথম ব্যবহার করলেন গ্রামশ্চির ধরনে ‘ন্যাশনাল পপুলার’ নির্মাণে।”

কবি সব্যসাচী দেব দীর্ঘকাল সিনেমা নিয়ে লিখছেন ইরাবান বসুরায় নামে। স্বভাবতই তাঁর চলচ্চিত্রীয় গদ্যে কবিতার হাতছানি লেগে থাকে। যেমন তাঁর ভালোবাসার সিনেমা: চার্লি চ্যাপলিন-এর (ঋতাক্ষর, ৩০০.০০) ‘দ্য কিড’ অধ্যায়টি: ‘পুরোনো বস্তির ঘরের দরজার সামনে বসে থাকতে থাকতে সব-হারানো ভেঙে-পড়া চার্লি ঘুমিয়ে পড়ে, আর তারপরে স্বপ্ন দেখে। সে এক আশ্চর্য স্বপ্ন, কল্পনার এক আশ্চর্য উদাহরণ, সেখানে সিনেমাটিক প্রয়োগদক্ষতার সঙ্গে মিশে যায় প্রগাঢ় মানবিক ভালোবাসার ভাবনা।’

চ্যাপলিন তাঁর সযত্ন-লালিত চর্চার বিষয়, আশির দশকের শেষেই চ্যাপলিনের (১৮৮৯-১৯৭৭) জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে ইরাবানের বই বেরয়। সে লেখাগুলি জায়গা পেয়েছে এই নতুন বইটিতেও, ‘যদিও সময়ের ব্যবধানে পুরোনো ভাবনা অনেকটাই বদলে যাওয়াতে লেখাগুলিতেও ঘষামাজা করতে হয়েছে প্রচুর।’— ভূমিকা-য় জানিয়েছেন লেখক। ফলে চ্যাপলিন নিয়ে সম্পূর্ণত হালফিল ভাবনার প্রকাশ এই নতুন বইটি। এ-পর্যন্ত চ্যাপলিন নিয়ে দেশি-বিদেশি রচয়িতাদের আলোচনা আত্মস্থ করে নতুন শতকের দ্বিতীয় দশকে দাঁড়িয়ে ইরাবান নতুন দৃষ্টিতে আলোচনা করেছেন চ্যাপলিনের ফিল্মগুলিকে। ফিল্ম থেকেই চ্যাপলিনকে চিনে নেওয়ার চেষ্টার সঙ্গে বাড়তি পাওনা চ্যাপলিনের বিস্তারিত চলচ্চিত্রপঞ্জি। এ-বছর চ্যাপলিনের ১২৫তম জন্মবর্ষ, এ-বছর তাঁর কর্মজীবনে প্রবেশেরও শতবর্ষ, এমন একটি বছরে ইরাবানের বইটি বাঙালি পাঠকের কাছে উপহার বইকী!

আরও পড়ুন
Advertisement