পুস্তক ২...

‘আমিই বা তাকে স্বীকার করব কেন?’

ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, অপরাজিতা দাশগুপ্ত। গাঙচিল, ২৫০.০০উনিশশো নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলা গদ্যসাহিত্যে একটি নতুন ধারা দেখা দিয়েছে সমকালীন মেয়েদের স্বজীবন লেখার ধারা। রাসসুন্দরী থেকে মনোদা দেবী থেকে বিনোদিনী পর্যন্ত মনে রেখেও বলা যায় এই লেখাগুলির ধরন ভিন্ন। পি এন হাকসারের স্ত্রী ঊর্মিলা হাকসার ষাটের দশকে যে চমৎকার আত্মজীবনীটি লেখেন, তা শেষ হয় তাঁর বিবাহপূর্ব জীবনেই, অর্থাৎ তেইশ বছর বয়সে।

Advertisement
জয়া মিত্র
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৪ ০০:০২

উনিশশো নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলা গদ্যসাহিত্যে একটি নতুন ধারা দেখা দিয়েছে সমকালীন মেয়েদের স্বজীবন লেখার ধারা। রাসসুন্দরী থেকে মনোদা দেবী থেকে বিনোদিনী পর্যন্ত মনে রেখেও বলা যায় এই লেখাগুলির ধরন ভিন্ন। পি এন হাকসারের স্ত্রী ঊর্মিলা হাকসার ষাটের দশকে যে চমৎকার আত্মজীবনীটি লেখেন, তা শেষ হয় তাঁর বিবাহপূর্ব জীবনেই, অর্থাৎ তেইশ বছর বয়সে। অতটা না হলেও, নব্বইয়ের মহিলা আত্মজীবনী লেখকরা নিজেদের কথা লিখছেন জীবনের প্রান্তে এসে মোটেই নয়, বরং উচ্চশিক্ষিত, সচেতন, কিছুটা বা নারীচেতনাবাদে বিশ্বাসী এই লেখকরা বেশ খোলামেলা ভাবেই নিজেদের বাঁচার কথা বলছেন কখনও উপন্যাসের স্বচ্ছ আবরণে, কখনও সরাসরি। সে রকমই একটি বই ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য। গ্রন্থকার অপরাজিতা দাশগুপ্তকে আদৌ অপরিচিত বলা যাবে না। বছর দশেক আগে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই সুরের স্মৃতি স্মৃতির সুর, পরে উপন্যাস ছায়াপথ। লেখনীর কুশলতা দুটিতেই ছিল স্বপ্রকাশ।

সেই কুশলতা ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য-তেও বর্তমান। নিজের জীবনের সুখ-দুঃখের নানান ঘটনা, এমনকী নার্সিংহোম থেকে শ্মশানচুল্লি পর্যন্ত মায়ের মৃত্যুর পর শেষযাত্রার বেদনাকেও পাঠকের মনে সঞ্চারিত করার দুরূহ দক্ষতা আছে লেখকের। শব্দবন্ধে সেই অনুভূতি প্রকাশ করার সময় তিনি শোকার্ত কিন্তু বেপথু নন। কন্যার স্মৃতিকথার অনেকখানি জুড়ে তাঁর মা থাকবেন, এটা স্বাভাবিক। অপরাজিতার স্মৃতিকথার সিংহভাগ নিয়ে আছেন অন্য পূর্বমাতৃকারাও। বালবিধবা, ঈষৎ ‘খাটো’ দিম্মা, উজ্জ্বল ধীময়ী ঠাকুমা, যিনি কিনা নিজের বই-এর প্রথম পৃষ্ঠায় নিজে হাতে লিখে দিয়েছেন ভবিষ্যতের লেখিকা নাতনির নাম, কিন্তু ফেটে যাওয়া, কালি চোঁয়ানো কলমেই সেই লেখা কারণ তাঁকে একটি কলম কিনে দেওয়ার কথা খেয়াল হয়নি কারও। আছেন দেওঘরের প্রাসাদোপম বাড়ি ‘শ্বেত দ্বীপ’-এর জীর্ণ কোণে ঠাকুমার মা, অথর্ব, প্রায়ান্ধ এক মহাদিদু আর তাঁর বৃদ্ধ পুত্র। পারিবারিক গণ্ডির বাইরেও রয়েছেন সেই মাতৃকারা, কখনও বালিকাবয়সের খেলার টিচার শ্রীমতীদি হয়ে, কখনও পুপেপিসি, কখনও আবার বাড়িতে কাজ করা লক্ষ্মীদি রূপে যে সহজ হাসিমুখে বলে ‘বর আমাকে স্বীকার করে না, আমিই বা তাকে স্বীকার করব কেন বলো? আমিও তাই সিঁদুর পরি না।’ আত্মহত্যা করা সুখী চেহারার তরুণী বউ, যার মেয়ে মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত, রাস্তার পাগলিবুড়ি, প্রতিবেশিনী মায়াপাগলি, কিশোরী বয়সের সহপাঠিনী শুক্লা-কৃষ্ণা নানা রকম মেয়েরাই যেন সারি দিয়ে আসে স্মৃতির সরণি বেয়ে। এবং একটি স্পষ্ট নারীদৃষ্টিভঙ্গি থেকেই চিত্রিত হয়েছে তাদের কথা মেয়েদের নিজস্ব দুঃখ-বেদনা-পুলক-প্রেম। এক দিকে প্রেমবিষয়ক লেখাগুলোতে উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি শারীরিকতার, অন্য দিকে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি, অন্তত তিনটি লেখায়, মা-মেয়ের মধ্যেকার সম্পর্কে ছায়া-আলোর বিচিত্র ভাঁজবিবরণ, যার মধ্যে আছে লেখকের নিজস্ব স্বীকারোক্তিও।

Advertisement

নাতিবৃহৎ এই বইটিতে ‘নারী চেতনা’ বা উওম্যানিজম-এর ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে বেশ স্পষ্ট করেই। নারী-পুরুষ = ভাল-খারাপ এই সরল সমীকরণের বদলে ছবির পর ছবিতে দেখা দেয় প্রসন্ন স্নেহশীল পুরুষ, উৎসুক কিশোর রাগী অকরুণ কন্যাদের পাশাপাশি।

যে কোনও স্মৃতিকথার মতোই ইচ্ছের গাছ... এরও প্রধান অংশ শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি। হয়তো সে জন্যই বইটির প্রতিটি অধ্যায়ই চিত্রিত যেন এক সোনালি আলোয়। বিষাদও সোনালি। সেই পৃথিবীর ধুলো-কাদাও মায়ায় মাখা। মলিন নয়। আর বিস্ময়কর ভাবে অনুপস্থিত লেখকের কৈশোরের চার দিকে উথলে ওঠা কলকাতার সত্তর দশক।

টুকরো টুকরো, কিছু বা নানা জায়গায় প্রকাশিত স্মৃতি-চিত্রণে গ্রন্থিত বইটিতে সবচেয়ে পুলকোজ্জ্বল লেখা বলে মনে হয় শেষ দু’টি অধ্যায়কে ইচ্ছের গাছ ও উড়ান। ‘ইচ্ছের গাছ’ থেকে একটি উদ্ধৃতি ‘আমার নিজের ছেলে। সন্তান। আমার ইচ্ছের নতুন চারা। ওকে আমি বৃক্ষ করে তুলব জল, মাটি, হাওয়া সব দিয়ে। সব ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাত নিজের মধ্যে ধারণ করে ছাতার মতো ঢেকে রাখব ওকে, আগলে রাখব।... এখন বুঝতে পারি আমি আর নিয়ন্ত্রক নই। পৃথিবীকে দেওয়া আমার একমাত্র ইচ্ছেগাছ নিজেই খুঁজে নিয়েছে তার মুক্তির উপায়।’ ‘উড়ান’ লেখাটিও আলো-উজ্জ্বল। লেখকের নিজেরই ভাষায় ‘সুখস্বপ্নের মতো’। দেড় বছরের ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে কেমব্রিজে লেখকের চার বছরের সংসারজীবন। শুধু একটু কাঁটা রয়ে যায়, লেখক ইতিহাসের ছাত্রী বলেই হয়তো বেশি, ভারতীয় সংস্কৃতিতে গভীরমনস্ক দুই বৈবাহিক পুরুষের গৌরব-পরিচয় দিতে গিয়ে কি বলতেই হবে ‘রেনেসাঁস’-এর কথা? যে ‘রেনেসাঁস’-এর চারিত্রে কোথাও নেই ভারতীয়ত্বের জায়গা? যে ‘নবজাগরণ’ আসলে পশ্চিমায়নের মাপকাঠিতে মুষ্টিমেয় কিছু বাঙালির ঔপনিবেশিক স্বীকৃতি?

আরও পড়ুন
Advertisement