চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

আধুনিকতার সঙ্গে পরম্পরার উজ্জ্বল উদ্ভাস

এখন সিমা-য় চলছে গ্রীষ্মের সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ আধুনিকতাবাদী ভাবনার ভিতরেও পরম্পরা কী ভাবে প্রতিধ্বনিত হয়, তারই কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়ে গেছে সিমা-র গ্রীষ্মকালীন প্রদর্শনীতে। আনওয়ার চিত্রকরের মিশ্রমাধ্যমের রচনা ‘দুর্গা’য় লৌকিক পরম্পরা আধুনিকতায় সমন্বিত হয়েছে অসামান্য ঋদ্ধতায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৪ ০০:০২

প্রতি বছরের মতো সিমা গ্যালারিতে এখন চলছে গ্রীষ্মের প্রদর্শনী। ছবি ও ভাস্কর্য মিলিয়ে মোট ৫১টি কাজের মধ্য দিয়ে আভাসিত হয়েছে সাম্প্রতিক শিল্পচর্চার একটি রূপরেখা। সময়ের জটিলতা ও মূল্যবোধের ভাঙনের মধ্যেও উজ্জীবনের এক সূক্ষ্ম আলোকরশ্মি প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এ প্রদর্শনী প্রচ্ছন্ন ভাবে এ রকমই এক বার্তা নিয়ে আসে দর্শকের কাছে।

এই সম্মেলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ১৯৬০-এর দশকের পরবর্তী ছবি ও ভাস্কর্যের বিকাশের উপর। ছবিতে ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন মাত্র তিন জন: পরমজিৎ সিংহ, লালুপ্রসাদ সাউ এবং অঞ্জু চৌধুরী। তিন জনের ছবিতেই রয়েছে স্নিগ্ধ সদর্থকতার আবহ। পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের কাজে ভাবনা ও আঙ্গিকের যে বৈচিত্র সেটাই এই প্রদর্শনীকে তাৎপর্যপূর্ণ করেছে। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রটি আগে আমরা অনুধাবনের চেষ্টা করব।

Advertisement

আট জন শিল্পীর মোট ন’টি ভাস্কর্য রয়েছে প্রদর্শনীতে। সুষেণ ঘোষ এঁদের মধ্যে প্রবীণতম। গাণিতিক বিমূর্ততায় অসামান্য অবদান রেখেছেন ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত এই ভাস্কর। ‘স্পেস অ্যারাউন্ড’ শীর্ষক ব্রোঞ্জের রচনাটিতে দু’টি অর্ধগোলকাংশের পারস্পরিক অবস্থান নিয়ে কাজ করেছেন। জনক ঝংকার নার্জারির পাথর কেটে গড়ে তোলা রচনাটির শিরোনাম ‘দ্য রিভার অ্যান্ড কালচার’। স্থাপত্যের জ্যামিতির সঙ্গে নিসর্গের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক দার্শনিক প্রত্যয়কে উন্মীলিত করতে চেয়েছেন তিনি। ভাবনা ও আঙ্গিকে উজ্জ্বলতর রচনাটি পঙ্কজ পাওয়ার-এর। ‘ব্যাটল অব দ্য অ্যাঞ্জেল’ শিরোনামের ফাইবার গ্লাস ও কাঠের রচনাটিতে স্বাভাবিকতাকে জাদুবাস্তবতার দিকে নিয়ে গেছেন শিল্পী। দুটি নগ্ন পুরুষের শরীরী সংঘর্ষের ভিতর দিয়ে আভাসিত হয়েছে এই সময়ের অন্তর্লীন শূন্যতা। সমীর আইচের দুটি ধাতব ভাস্কর্যে বাস্তবতা বিশ্লিষ্ট হয়েছে কল্পরূপাত্মক অনুষঙ্গে। তরুণতর ভাস্করদের মধ্যে ছিলেন অঞ্জুম সিংহ, ফারহাদ হুসেন, তাপস বিশ্বাস ও সত্যজিৎ রায়। ধাতব তারের রচনাতে তাপস এক স্বকীয় রূপরীতি উদ্ভাবন করতে চেয়েছেন।

আধুনিকতাবাদী ভাবনার ভিতরেও পরম্পরা কী ভাবে প্রতিধ্বনিত হয়, তারই কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়ে গেছে এ বারের ছবির নির্বাচনে। আনওয়ার চিত্রকরের মিশ্রমাধ্যমের রচনা ‘দুর্গা’য় লৌকিক পরম্পরা আধুনিকতায় সমন্বিত হয়েছে অসামান্য ঋদ্ধতায়। কিন্তু পূর্বোক্ত প্রতিধ্বনির অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করা যায় কিংশুক সরকারের রচনাটিকে। শিরোনাম ‘মিলিয়ন বার্ডস ফ্লাই’। বিমূর্তায়িত এই নিসর্গরচনাটি শিল্পী গড়ে তুলেছেন নানা রকম প্রাকৃতিক উপকরণের সুচারু ব্যবহারে। এর মধ্যে রয়েছে বৃক্ষের তন্তু, মাছ ধরার জাল, পাখির বাসা, প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ আঠা, রেশম ও অন্যান্য বস্ত্রতন্তু ইত্যাদি। সাম্প্রতিকের জটিলতা চিরন্তনের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে। তমিস্রার ভিতর আলোকিত উদ্ভাসের আলেখ্য এঁকেছেন ইন্দ্রপ্রমিত রায়। ‘ফায়ারওয়ার্কস’ শীর্ষক অ্যাক্রিলিকের ক্যনভাসটি তাঁর নিজস্ব রূপরীতিরও আলোকিত উত্তরণের দৃষ্টান্ত। পুরাণকল্পের সঙ্গে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের আবহকে মিলিয়েছেন শাকিলা তাঁর কোলাজের রচনাটিতে। সম্মুখপটে দণ্ডায়মানা মা কালী আর পশ্চাৎপটে আণবিক অস্ত্রের আভাস। সমধর্মী আলোড়িত বাস্তবতাকে ভিন্নধর্মী আঙ্গিকে রূপায়িত করেছেন সৌগত দাস। তাঁর মিশ্রমাধ্যমের রচনাটির শিরোনাম ‘স্টর্ম ইন আ টি কাপ’। চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে, তাতে উড়ছে মানুষ, অস্ত্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতীক ইত্যাদি। অতনু মুখোপাধ্যায়ের তেলরঙের ক্যানভাসটিতে সহজ রূপবন্ধে প্রকট হয়ে উঠেছে মানবিক বিপন্নতা। অভিব্যক্তিধর্মী স্বাভাবিকতার রূপারোপ পি এস জালাজা-র জলরঙের রচনাটিতে। কোনও রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতাকে ঘিরে ভিড়াক্রান্ত উচ্ছ্বসিত জনতার সমাবেশ তাঁর ছবির বিষয়। বিমূর্ত রচনা হিসেবে বিশেষ ভাবে স্পর্শ করে প্রদীপ রক্ষিতের ‘সাইলেন্স জোন’।

ছবিতে অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন পরেশ মাইতি, প্রশান্ত সাহু, সুমিত্র বসাক, অপর্ণা কাউর, জয়শ্রী বর্মন, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, সুমন কবিরাজ, বহুলেয়ান সি বি, সেবাস্তিয়ান ভার্গিস, আবির কর্মকার, ইউসুফ, বিশাখা আপ্তে প্রমুখ।

আরও পড়ুন
Advertisement