চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

অজস্র চোখ জেগে থাকে পরিব্যাপ্ত আঁধারে

মায়া আর্ট স্পেসে অনুষ্ঠিত পার্থ দাশগুপ্তের প্রদর্শনীটি দেখলেন মৃণাল ঘোষ।মায়া আর্ট স্পেসে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল পার্থ দাশগুপ্ত-র সিরামিক-ভিত্তিক শিল্প নিয়ে একক প্রদর্শনী। যার শিরোনাম: ‘অমৃত’। কেন অমৃত? মায়া আর্ট স্পেসে অনুষ্ঠিত পার্থ দাশগুপ্তের প্রদর্শনীটি দেখলেন মৃণাল ঘোষ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০

মায়া আর্ট স্পেসে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল পার্থ দাশগুপ্ত-র সিরামিক-ভিত্তিক শিল্প নিয়ে একক প্রদর্শনী। যার শিরোনাম: ‘অমৃত’। কেন অমৃত? অমৃত বহু অর্থ-ব্যঞ্জক একটি শব্দ। এর প্রাথমিক অর্থ— যা মৃত্যু রোধ করে। যা পান করলে মৃত্যু হয় না। কিন্তু একটি প্রসারিত অর্থও আছে। যা আনন্দের সঙ্গে যুক্ত। একটি ব্রক্ষ্মসঙ্গীতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এ ভাবে: ‘জননীর স্নেহপ্রীতি, শতধারে সুধা চালে নিতি নিতি, জগতের প্রেম মধুর মাধুরী, ডুবায়ে অমৃত-সরসে’। এখানে অমৃত অর্থ আনন্দ। পার্থ হয়তো আনন্দ অর্থেই ‘অমৃত’ শব্দটি ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এবং সেই আনন্দ ধরিত্রীর সঙ্গে যুক্ত। ধরিত্রীর সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক ও প্রত্যক্ষ পরিচয় মৃত্তিকার মধ্য দিয়ে। মৃত্তিকা প্রাণকে ধারণ করে। মৃত্তিকা মানুষের আনন্দ-নির্মাণের, অর্থান্তরে শিল্প-নির্মাণেরও একটি বড় উপাদান। অনাদি কাল থেকেই মানুষ মাটি দিয়ে শিল্প গড়ছে। সেই মৃত্তিকা ভিত্তিক শিল্পের নানা রূপ ও নানা প্রকরণ আছে। ‘সিরামিকস’ তারই একটি।

Advertisement

সিরামিক বা যে কোনও মৃত্তিকা-শিল্পের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত থাকে কয়েকটি উপাদান — মাটি, জল, অগ্নি ও বায়ু। এ সবই ধরিত্রীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এবং ধরিত্রীর অন্তর্লীন উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে আনন্দে অভিব্যক্ত হয়। এরকম বৃহত্তর অর্থেই হয়তো পার্থ ‘অমৃত’ শিরোনামটির কথা ভেবেছিলেন। যেভাবে রূপায়িত করেছেন তিনি তার ইনস্টলেশন ভিত্তিক রচনাগুলি, তা আমাদের এ কথা ভাবতেই উদ্বুদ্ধ করে। সুস্থিত দার্শনিক ভাবনা থেকেই উৎসারিত হয়েছে তাঁর রচনা।

সতীশ গুজরাল, জ্যোৎস্না ভাট, লতিকা কাট, মৃণালিনী মুখোপাধ্যায়, সরোজ পাল গোগি, এস. এল. প্রসার, অনিত্য রায় প্রমুখ কত শিল্পীই তো ব্যবহার করেছেন এই মাধ্যমটি। কিন্তু পার্থ-র সিরামিকসের শিল্পায়ন প্রচলিত ধারা থেকে অনেকটাই আলাদা।

শিল্পী যেভাবে দেশগত ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতাবাদ ও উত্তর-আধুনিকতাকে মেলান, তাতেই তাঁর শিল্প গভীর দার্শনিক প্রত্যয়ে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে।

পার্থ যে শুধু সিরামিকস বা স্টোনওয়ার-এর ভাস্কর্য করেছেন, তা নয়। ভাস্কর্যের সঙ্গে চিত্র মিলিয়ে ইনস্টলেশনধর্মী নির্মাণের ভিতর দিয়ে তিনি তাঁর ভাবনাকে ব্যক্ত করেছেন। রচনাগুলি বিশেষ পরিসর-ভিত্তিক বা সাইট-স্পেসিফিক। গ্যালারি কক্ষের সাদা দেয়ালের প্রেক্ষাপটে তাঁর চিত্রগুলিকে আঁধারের প্রাধান্য। সেগুলি মূলত বিমূর্ত। যদিও দৃশ্যমান কিছু অবয়বের আভাস কোথাও কোথাও আছে। সেই ছবিকে পশ্চাৎপটে রেখে সম্মুখভাগে স্থাপিত হয়েছে সিরামিকের ভাস্কর্য। দুইয়ে মিলে যে দৃশ্যতার পরিমণ্ডল, তাতেই অভিব্যক্ত হয় এক অন্তর্লীন দর্শন, বিশ্বপ্রবাহের গভীর থেকে যা উঠে আসে এবং বিমূর্ত এক আন্দোলনের পারাবারে আন্দোলিত হতে থাকে। ‘হর্সেস অন পিলার্স’ শিরোনামের রচনাটিতে, পশ্চাৎপটের দেয়াল জোড়া চিত্রটিতে পরিব্যাপ্ত আঁধারের পরিমণ্ডলে অজস্র চোখ জেগে থাকে। যেন অনন্ত অতীতের দৃষ্টি প্রসারিত হয়ে আছে পরবর্তী যুগ যুগান্তরের দিকে। সে দৃষ্টিতে বিস্ময় আছে এবং অনুচ্চারিত বেদনাও আছে। তার সামনে চারটি সিরামিকসেরই পেডেস্টালের উপরে স্থাপিত রয়েছে চারটি অশ্ব-আকৃতির অবয়ব। এগুলি সুস্পষ্ট কোনও ঘোড়া নয়। অনেকটা যেন ঘোড়ার আদলের প্রাগৈতিহাসিক কোনও প্রাণী। লক্ষণীয়, তাঁরা দাঁড়িয়ে আছে যে স্তম্ভের উপর, সেগুলিও হাল্কা রিলিফে মূর্ত ও বিমূর্তভাবে চিত্রিত। কোথাও সঞ্চরমান জলস্রোত, কোথাও অন্ধকারে আলোর বিচ্ছুরণ। অশ্বকেন্দ্রিক এই ত্রিমাত্রিক রূপবন্ধের সঙ্গে পশ্চাৎপটের দ্বিমাত্রিক অক্ষি-বিচ্ছুরিত চিত্রের নীরব সংলাপ আলোচ্য রচনাটির প্রধান উপজীব্য। এর ভিতর দিয়ে যে ভাবের দ্যোতনা জাগে তা কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আবদ্ধ নয়। এই অনির্দিষ্টতার ভিতর দিয়েই শিল্পী এই প্রপঞ্চের নিহিত মায়াকে অভিব্যক্ত করতে চান।

‘তরঙ্গ’ নামের স্টোনওয়ার রচনাটি। আয়তাকার প্রস্থচ্ছেদের আলো-ছায়া বেষ্টিত ত্রিমাত্রিক স্তম্ভসদৃশ নির্মাণটির পৃষ্ঠতলে রূপায়িত হয়েছে প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ— সমুদ্র-তরঙ্গ, জলভারনম্র কৃষ্ণাভ মেঘ, আলোকিত প্রান্তরে প্রসারিত দৃষ্টির প্রতীক কোনও চোখ ইত্যাদি। তাঁর রূপায়ণের বৈশিষ্ট্য, নির্দিষ্ট কোনও আখ্যানের মধ্যে না গিয়ে অনেকটাই বিমূর্ত সংকেতের ভিতর দিয়ে তিনি তাঁর ভাবনাকে ব্যক্ত করেন, যা কবিতার মতো নানা ব্যঞ্জনায় ব্যঞ্জিত হয়ে ওঠে। এভাবেই তিনি তাঁর বিশ্বদৃষ্টির ব্যাপ্তিকে রূপায়িত করতে চেষ্টা করেন।

আরও পড়ুন
Advertisement