পুস্তক পরিচয় ১

বারো মাসে তেরো পার্বণ

উ  ৎসবে-পরবে মনে এক অন্তরীক্ষের জগৎ গড়ে ওঠে; যেখানে পুজো উপাসনা নমাজ ব্রত নিয়ম আচারের নানা দৃশ্য আর সংলাপ তৈরি হয়। ব্যক্তি মানুষও বৃহত্তর সমাজ চৌহদ্দিতে মিলেমিশে যায়।

Advertisement
দীপঙ্কর ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০২
থার্টিন ফেস্টিভ্যালস/ আ রিচুয়াল ইয়ার ইন বেঙ্গল। রালফ ডব্লিউ নিকোলাস। ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান/আর সি এস পাবলিশার্স, ৭৫০.০০

থার্টিন ফেস্টিভ্যালস/ আ রিচুয়াল ইয়ার ইন বেঙ্গল। রালফ ডব্লিউ নিকোলাস। ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান/আর সি এস পাবলিশার্স, ৭৫০.০০

উ  ৎসবে-পরবে মনে এক অন্তরীক্ষের জগৎ গড়ে ওঠে; যেখানে পুজো উপাসনা নমাজ ব্রত নিয়ম আচারের নানা দৃশ্য আর সংলাপ তৈরি হয়। ব্যক্তি মানুষও বৃহত্তর সমাজ চৌহদ্দিতে মিলেমিশে যায়। এটাই পরবের অন্তর্ভেদী রূপ। আজও স্মৃতিটানে ছবির মতো ধরা আছে— ইছামতীর জলতরঙ্গে দিনশেষের আলোয়, জোড়া নৌকা আলাদা হয়ে প্রতিমা যাচ্ছে তলিয়ে। ডাঙায় বিজয়ার মেলার কলরব ছাপিয়ে, আশপাশের নৌকা থেকে ঢাকির আড়ষ্ট বাজনার শব্দ ভেসে আসত। দুপুরে বাংলাদেশের মাটি ঘেঁষে নৌকাবাইচও শেষ হত এই গোপালপুর ঘাটে। উৎসব শেষের দৃশ্য মিলিয়ে যেত ভিড়ের মধ্যে থেকে হ্যাজাকের ম্লান আলো নদীজলে পড়ে। ভক্তির সঙ্গে শুধু আনন্দমুখরতা নয়, মৌন বিষাদও মিশে থাকে উৎসবের আঙিনায়। বীরভূমের এক ভিতর-গাঁয়ে, বয়োবৃদ্ধ মানুষটি পুজোর দিনে পারিবারিক দুর্গাপটটি দেখাতে দেখাতেই কাঁদছিলেন। জিজ্ঞাসা করিনি; পরিজন প্রতিবেশের স্মৃতি কি জড়িয়ে পড়ে এমন সন্ধিক্ষণেই? পালপার্বণের আবহে পাওয়া যায় বাংলার আটপৌরে সমাজজীবনের মহার্ঘ সংকেত। বছর দুয়েক আগে পূর্ব মেদিনীপুরের এক গ্রামীণ আসরে যাচ্ছিলাম শীতলামঙ্গলের শিল্পীর সঙ্গে কথা বলতে। রাস্তায় দেখা বয়স্ক সহযাত্রী পরিচয় পেয়ে বললেন, তিনিও প্রতি বছর ওই বাড়িতে যান— ‘শ্রবণ করি ভাগবত।’ ভাষাশৈলীর এমন আকাঁড়া ব্যবহারে থমকে যাই। তা, সেখানে গিয়ে দেখছি কুলগুরুর মাখা ভাত-তরকারি কয়েকজন একটু একটু পেয়ে ভক্তিভরে খাচ্ছেন। একই পংক্তিতে বসে সে-সব দেখতে দেখতে আনমনা ভাব কেটে গেল পরিবেশনকারীর কথায়— ‘ব্যঞ্জন নেবেন?’ এমন আয়োজনেও তৈরি হয় স্বতন্ত্র দৃশ্যায়ন আর কথালাপ। শুধুই কি শ্রদ্ধা, শুভলাভ বা অজানা শক্তির ভয় থেকে পরিত্রাণের আকুতি থাকে পুজো-উপচারে?

ধর্মসংস্কৃতির মনন কোনও একরৈখিক মানদণ্ড নয়— পরতের পর পরতে সেখানে বহুবিচিত্র স্বরলিপি তৈরি হয়। বারো মাসে তেরো পার্বণের ব্যঞ্জনাও কথার কথা— বাস্তবে সময়ের অতিরেক, উপচে পড়া। এই চর্চায় উৎসব শুধু বাঙালি হিন্দুর মূর্তিপূজোর আয়োজন নয়— বছরভর পার্বণের কার্যক্রমিক বর্ণনা, জাতিগোষ্ঠীর মানসিক অভিরুচি আর গ্রামীণ মানুষের বোধ আর মতের অন্তর্জগৎ উদ্ঘাটনের পরম্পরার খোঁজ। নৃতাত্ত্বিক রালফ ডব্লিউ নিকোলাস এই বৃহত্তর প্রেক্ষাপট পরখ করেছেন আজকের পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামচর্চায়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক তাঁর যুবা বয়সে, ১৯৬০-এ চলে এলেন বাংলায়। স্বদেশচেতনায় ঋদ্ধ নির্মলকুমার বসুর নৃতত্ত্ব ভাবনার প্রণোদনা আর ভরসায় শুরু করলেন গবেষণার কাজ। এপার ওপার মিলে তখন ঘুরেছেন বাস্তুসংস্থান, আর্থ-রাজনীতির সন্ধানী হয়ে। পরে গ্রামভিত্তিক চর্চায় ধর্মীয় আচরণের মধ্যে বঙ্গসংস্কৃতির ভরকেন্দ্র দেখা তাঁর অন্যতম গবেষণাভিত্তি হয়ে উঠল। সেই ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সময়কালে তখনকার অবিভক্ত মেদিনীপুরের এক গ্রামীণ চৌহদ্দিতে দিনরাত কাটিয়েছেন এই নৃবিজ্ঞানী। বলা যায়, তাঁর গবেষণা-জীবনই কাটালেন বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিকে বুঝতে। এক দশক আগেও কথায় কথায় বলছিলেন— ‘এই বাংলার গ্রাম আর গ্রামের মানুষ খুব সুন্দর— আমার স্মৃতিতে আজও সজীব।’ সেই অনুভবী মন নিয়েই দেখেছিলেন জীবন-সত্যের সঙ্গে মেশা পৌরাণিক ধারার কৌলীন্যের শরৎকালীন দুর্গা, আর বসন্তের শিব-গাজনে আমজনতার একাত্মতা। এ ছাড়াও, পৌরাণিক ও লৌকিক নানা দেবদেবীর আরাধনা এবং শৈব শাক্ত বৈষ্ণবীয় আচার-অভিধা। শীতলা, মনসা, বিশ্বকর্মা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কৃষ্ণ, সূর্য, সত্যনারায়ণ অথবা সত্যপির, ষষ্ঠী, চণ্ডী, ওলাবিবি, ধর্মঠাকুর ইত্যাদির পুজোপচার আছে বাঙালির গ্রামজীবনে। এ সবের নৃবিজ্ঞানীসুলভ মূল্যায়ন বস্তুতই পালনীয় জনদের ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। এক বার তারকেশ্বরের শিবমন্দিরে ঠাসা ভিড়ের মধ্যে দণ্ডী কাটা দেখছিলেন। এক জন বয়স্ক মহিলা দণ্ডী কাটতে কাটতে ভাবালুতায় আমেরিকান সাহেবের লম্বা ফরসা পা সামনে দেখে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন! ভ্রুক্ষেপ ছিল না কোনও দিকে সেই গ্রামীণ মহিলার। ‘মা ছেড়ে দিন’ বলেও নিকোলাস নিস্তার পাননি তৎক্ষণাৎ। কারণ, ‘স্বয়ম্ভু বাবা’-কে হঠাৎ এমন কাছে পেয়ে মহিলা তখন আত্মহারা! দেখতে দেখতে অভিজ্ঞতাও হয়েছে চমকপ্রদ।

Advertisement

আচার-বিচারের নৈমিত্তিকতা আমাদের সহজিয়া চোখে বহু ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যায়। আচারকেন্দ্রিক প্রতীক ও সাংস্কৃতিক উপাদানের কার্যধারা অবলোকনে নিকোলাস সংগঠিত ও স্পষ্ট। পাঁচটি মৌজায় ভুবনকালুয়া, মুরারিকালুয়া, সাতকালুয়া, নরসিংকালুয়া, বলীকালুয়া, রামকালুয়া, বনমালিকালুয়া, ডুবকালুয়া— এই আটটি গ্রামের সম্মিলিত কেলোমাল বাংলার প্রেক্ষিতে প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, নিকোলাসের অন্বেষণের সময়েও ছিল না। কৃষি এলাকায় পানবরজের বর্ণনায়, ‘ঠক-ঠকি’ তাঁতের কাজ, মাহিষ্য জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা, ব্রাহ্মণদের উপভাগ বিভক্তে ক্রিয়াপদ্ধতি, কায়স্থ, নবশাখ সম্প্রদায়-সহ অন্য জাতি, কয়েক ঘর মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে চৌহদ্দির জীবনাচরণ তৈরি হয়েছে পরবের আঙিনায়। গ্রাম, পাড়া, জাতি, বংশ, পরিবার— এমন নানাস্তরীয় বিন্যাসের মধ্যে সমষ্টিজীবনের অস্তিত্ব প্রকাশিত হয়। হিন্দু ধর্মের বহুবিশ্বাসী আর বহুলাংশে অনুশাসনহীন ধর্মমতে, বহুজাতিবিশিষ্ট ভেদাভেদে সমাজ সংগঠনের সম্পর্কসূত্র দেখার কাজটি জটিল। গ্রামসংস্কৃতির জায়মান জীবনের এই চর্চার পরিক্রমণ তাই বৃহত্তর পরিসরের ইঙ্গিতবাহী।

রথের মেলা। মহিষাদল, পূর্ব মেদিনীপুর

নিকোলাসের বর্ণনাও সুচারু বিন্যাসে স্বতন্ত্র। সেই সময়ে এখানে যে খুব লেখাপড়া জানা শিক্ষিত পরিবেশ তা নয়— কিন্তু বুদ্ধিমত্তায় ছিল ভরপুর। এক জন মহিলা তো ধর্মাচারের প্রশ্নে উত্তরের শুরুতেই বলতেন— ‘আপনি এটা বিশ্বাস করবেন না।’ ক্ষেত্রসমীক্ষায় এমন ‘দেখার’ মুন্সিয়ানাতেই বৈষ্ণব ধর্মমতের সমাধি বা তুলসীমঞ্চের আকার-অবস্থান শুধু নয়, তার পোড়ামাটির রূপের তথ্যও এড়িয়ে যায়নি। নৃতত্ত্বের সমন্বিত চর্চার অন্তঃপ্রবিষ্ট উদাহরণ এই কাজটি। লক্ষ্মীপুজোর পুরাণ ও তিথিতত্ত্বের বাইরে দেশাচার ও লোকাচারের রীতি; ভাদ্রলক্ষ্মী, পৌষলক্ষ্মী, কোজাগরি ইত্যাদির ব্রতকথা যে নিষ্ঠায় বিন্যস্ত করেছেন, তা সমাজবিজ্ঞান চর্চার প্রয়োগনিপুণতার অন্যতম মডেল হতে পারে। বেদ-পুরাণ-মহাকাব্যের ধারায় বৃহত্তর বাংলায় আছে পুজো-উৎসবের নানা ধরন। দেবদেবীর অধিষ্ঠানে চন্দ্র, সূর্য, তারা, পৃথিবীর অয়নকাল বুঝেছেন— পঞ্জিকা ঘেঁটেছেন। যোগেশচন্দ্র রায়ের পূজা-পার্বণ-এর মতো বাংলা বই থেকেও পেয়েছেন দেশকালের বাঙালির পুজোপচারের ঠিক-ঠিকানা। এই সময়কালে যখন তিনি পণ্ডিতি মেধায় অর্ধশতক আগের তথ্য বিশ্লেষণ করছেন, তার শুরুতেই অবশ্য কবুলতনামা— ‘নৃতাত্ত্বিকরা প্রায়শই বিরক্তিকর হয়। কোনও জায়গা থেকে এসে কত দিন থাকবে তার ঠিকঠাকানা নেই। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায়, তথ্য লিপিবদ্ধ আর ছবি তোলার পর্ব— বহু দরকারি কার্যক্রমও দৃশ্যত মনে হয় যুক্তিহীন।’ এমন সতর্ক অনুভবে গ্রামীণ মানুষের বিশ্বজ্ঞানের মাত্রাও বুঝে নিয়েছেন। এ সব পরিপ্রেক্ষিত মোকাবিলায় উৎসবকেন্দ্রিক তাঁর যে খোঁজ, তারই ফল ফ্রুটস অব ওয়রশিপ (২০০৩), রাইটস অব স্প্রিং (২০০৮) এবং নাইট অব দ্য গডস (২০১৩) শীর্ষক প্রকাশনা। তেরো পার্বণের আলোচনায় সংশ্লিষ্ট এ সব বইয়ের প্রসঙ্গ এনে অবশ্য বলেছেন— অলমিতি বিস্তারেণ।

প্রত্যেক জেলারই নিজস্ব সত্তা আছে। ভূ-প্রকৃতি, জনগোষ্ঠীর বসবাস, পেশা, ভাষা, ইতিহাসের টানাপড়েনে তা বোঝা যায়। আর থাকে আঞ্চলিকতার মন-মানসিকতা। এ সবই বহুলাংশে আগ্রাসী নগরকেন্দ্রিকতার সংযোগ-সম্পর্কে ফিকে হয়ে আসে। গ্রামজীবনের পরিবারকেন্দ্রিকতার বহমান অন্তঃপটে বিন্দুতে সিন্ধু দেখার কৌশল একেবারে বিরল তা নয়— তবু, দেখা ও বিশ্লেষণের চমৎকারিত্বের সম্বল বড় করে ধরা আছে এই বইতে। প্রেক্ষাপটের নিরিখে পাল্টে যায় দেশ-রাজ্য-জেলা-গ্রাম। পঞ্চাশ বছর আগে নৃ-বিজ্ঞান গবেষণার যে কাজ করেছিলেন নিকোলাস, তা সমন্বয়ী একাত্মতার ধর্মীয় জীবনবোধের বাস্তব কাহিনি। স্ত্রী মার্তা, গবেষক তারাশিস মুখোপাধ্যায় সঙ্গী ছিলেন কাজের সময়কালে। উত্তর ভারতের গ্রামজীবনে ১৯৫২ সালের দোল উৎসবের অভিজ্ঞতা ম্যাকিম ম্যারিওট ১৯৬৬-তে লিখেছিলেন। নিকোলাস ১৯৬৯-এ এই বাংলার তমলুক এলাকার গ্রামে দোলউৎসবে যে রঙিন হয়েছিলেন, তা লিখলেন সম্প্রতি। ঔপন্যাসিক বর্ণনা নয়— সঞ্জীবিত তথ্যের বয়ানে বাংলার অন্তর ছোঁয়া সামাজিক দলিল এই রচনা। তথ্য-আলেখ্যের নির্মিতিতে তিনি গ্রামীণ পরবের আঙিনায় দেখিয়েছেন, সমাজ-অন্বেষণের দিশা-নির্দেশক বৃহত্তর সীমানা।

আরও পড়ুন
Advertisement