চিত্রকলা ও ভাস্কর্য১

সনাতন মূল্যবোধে নিয়ন্ত্রিত জীবনের প্রতিচ্ছবি

স্টুডিও ২১-এ অনুষ্ঠিত নীলাঞ্জন দাসের একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষভালবাসা মানুষের শ্রেষ্ঠতম এক অভিজ্ঞান, যা তাকে নব নব রূপে সৃজন করে, উদ্ভাসিত করে। যুগ যুগান্তর থেকে এর নানা রূপ যেমন আমরা দেখেছি, তেমনই দেখেছি নানা বিসংবাদ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
শিল্পী: নীলাঞ্জন দাস

শিল্পী: নীলাঞ্জন দাস

ভালবাসা মানুষের শ্রেষ্ঠতম এক অভিজ্ঞান, যা তাকে নব নব রূপে সৃজন করে, উদ্ভাসিত করে। যুগ যুগান্তর থেকে এর নানা রূপ যেমন আমরা দেখেছি, তেমনই দেখেছি নানা বিসংবাদ। খাজুরাহো বা কোনার্কের ভাস্কর্য, তাজমহলের স্থাপত্যে, রাধা-কৃষ্ণের লোকগাথায়, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাসের বৈষ্ণব পদাবলিতে, এমনকী এডভার মুংক-এর ছবিতে ভালবাসার আলো-আঁধার নানা মাত্রায় বিশ্লেষিত হয়ে আসছে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে। আজকের তথ্য-প্রযুক্তি অধ্যুষিত বিশ্বায়িত ভুবনে লোভ ও লাভ যখন জীবনের প্রধান নিয়ন্ত্রক, তখন প্রেমের অভিজ্ঞানে কি কোনও পরিবর্তন এসেছে? কেমন সেই পরিবর্তন?

এই প্রজন্মকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে স্টুডিও ২১-এ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তরুণ শিল্পী নীলাঞ্জন দাসের প্রদর্শনীর রচনাগুলি। ১১-টি কাজ নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘শেডস অব গ্রে’। উজ্জীবনের আলোকে আবৃত করছে ধূসরতা। সেই ধূসরের নানা প্রচ্ছায়াকে অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন শিল্পী উত্তর-আধুনিকতা সঞ্জাত কনসেপচুয়াল আর্ট-এর ভাষায়। এই আর্ট-এর একটি বৈশিষ্ট্য, ভাবনা বা দর্শনই সেখানে প্রকাশের প্রধান নিয়ন্ত্রক। সেই দর্শন বা কনসেপ্ট সম্পর্কে সম্যক অবহিত না হলে দৃশ্যের পাঠোদ্ধার দুরূহ। এ জন্য ‘কনসেপ্ট’ আর ‘এক্সপ্রেশন’-এর মধ্যে একটা শূন্য পরিসর অনেক সময় থেকে যায়। দৃশ্যের মায়ায় না ভুলিয়ে নীলাঞ্জন কীভাবে সেই শূন্য পরিসর নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সেটাই তাঁর সাফল্য ও সীমাবদ্ধতার নিরিখ।

Advertisement

ছাপচিত্র এই শিল্পীর অনুধ্যান ও গবেষণার বিষয়। ২০১২-তে তিনি রবীন্দ্রভারতী থেকে ছাপচিত্রে স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেছেন। তার পর থেকে ছাপচিত্র নিয়ে নতুন নিরীক্ষায় নিরত আছেন। এরই নানা প্রকাশ এই প্রদর্শনীতে। উত্তর-আধুনিকতার একটি বৈশিষ্ট্য, তা ঐতিহ্যকে নতুন মাত্রায় অনুধাবন করতে চায়। সেই নিরিখেই সাম্প্রতিককে প্রশ্ন করে এর অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভাষ্য রচনা করে। নীলাঞ্জন এই প্রদর্শনীতে সেটাই করেছেন। প্রেমের অতীত উৎসগুলির যে উল্লেখ করা হয়েছে আগে, তার সব ক’টিরই নিরীক্ষা রয়েছে তাঁর কাজে।

এই লেখার সঙ্গে যে ছবিটি, তার শিরোনাম ‘সতী-সাবিত্রী’। যে মেয়েটির মুখ চিত্রায়িত হয়েছে তা করা হয়েছে সেরিগ্রাফি প্রকরণে পপ-আর্ট ভিত্তিক বিন্দুমাত্রিক বুনোটে। মেয়েটি ফোনে কথা বলছে। যে কাঠের বাক্সে স্থাপিত এই চিত্র-প্রতিমা তার পাশে একটি প্রকৃত টেলিফোন রিসিভার সংলগ্ন আছে। দর্শক কানে দিলে একটি সংলাপ শুনতে পাবেন। বিবাহিতা এই মেয়েটির প্রাক্তন প্রেমিক তাঁকে ফোন করেছে। উত্তরে মেয়েটি বলছে সে এখন বিবাহিত, তার সঙ্গে ছেলেটি যেন কোনও যোগাযোগ না রাখে। সনাতন মূল্যবোধ আজকের জীবনকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটাকেই উদ্ঘাটিত করার চেষ্টা করেছেন শিল্পী।

‘রেড রোজ অ্যান্ড তাজ’ শীর্ষক রচনাটি ডিজিটাল প্রিন্ট ও সেরিগ্রাফি মাধ্যমে তৈরি। তিনটি প্যানেলের মাঝখানে রয়েছে তাজমহল। আর দু’পাশে মুমতাজ ও শাহজাহানের প্রতিকৃতি। তাজমহল সংক্রান্ত আর একটি রচনায় যমুনা নদীকে আনা হয়েছে। তাজমহলের নির্মাণকালে যে যমুনা ছিল নির্মল স্রোতস্বিনী, আজ তা দূষিত, আবর্জনাপূর্ণ। তাজমহলের শীর্ষে স্বর্ণ-নির্মিত একটি পাত্রাধার ছিল। তার একটি প্রস্তর-প্রতিলিপি সামনের উদ্যানে রাখা থাকে। দর্শককে বলা হয়, ওখানে তাঁর ভালবাসার মানুষকে স্মরণ করে আঘাত করলে, যদি সেই ভালবাসা সত্য হয়, তা হলে পাত্র থেকে জল নির্ঝরিত হবে। শিল্পী এই খেলাটির একটি স্মারক তৈরি করেছেন। প্রেমের সত্য ও মিথ্যা যাচাইয়ের খেলা।

‘দ্য মিথ অব লাভ-ট্র্যাঙ্গল’-এ শিল্পী ত্রিকোণ-প্রেমের রহস্য সন্ধানের চেষ্টা করেছেন। এই বিষয়ে মুংক-এর একটি ছবির প্রতিলিপি সংস্থাপন করে, তিনটি চরিত্রকে ছুঁয়ে একটি ত্রিভুজ এঁকেছেন। দেখিয়েছেন ত্রিভুজের দীর্ঘতম বাহুর দুপাশে অবস্থান করছে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রেমিক। হিংসা ও সংঘাত সেখানেই সবচেয়ে বেশি।

‘মি অ্যান্ড মাই জি.এফ. শীর্ষক উডকাট ও সিনকোলে মাধ্যমের রচনায় দুটি বোতলের প্রতিলিপি মুখোমুখি সংস্থাপিত হয়েছে। এই হাল্কা পানীয় আর একটি বিয়ারের বোতল। জি. এফ. অর্থ গার্ল ফ্রেন্ড। পুরুষ ও নারীর প্রেমের তীব্রতার যে মাত্রা নির্ধারণের প্রয়াস এখানে, তা খুব স্বচ্ছ নয়। এই রকম বহুমাত্রিক রচনায় শিল্পী প্রেমের বিশ্লেষণ করেছেন বিভিন্ন দিক থেকে।

প্রদর্শনী

চলছে বিড়লা

অ্যাকাডেমি: • রূপাতন নস্কর ২৯ থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

অশোক দে, তপন শেঠ প্রমুখ ২৭ পর্যন্ত।

আরও পড়ুন
Advertisement