পুস্তক পরিচয় ২

প্রেমটা তখন অত স্মার্ট ব্যাপার ছিল না

শান্তিনিকেতনে অবনপল্লির স্থায়ী বাসিন্দা সুব্রত সেন মজুমদার (জ. ১৯৪৪) সেখানকার আশ্রমিক সঙ্ঘের সম্পাদক। আশ্রমবালক হিসেবে আশৈশব শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির কোলে তাঁর বেড়ে ওঠা, পাঠভবন থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষালাভ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

শান্তিনিকেতনে অবনপল্লির স্থায়ী বাসিন্দা সুব্রত সেন মজুমদার (জ. ১৯৪৪) সেখানকার আশ্রমিক সঙ্ঘের সম্পাদক। আশ্রমবালক হিসেবে আশৈশব শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির কোলে তাঁর বেড়ে ওঠা, পাঠভবন থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষালাভ। অবসর অবধি যুক্ত ছিলেন সেখানে শিক্ষকতার কাজে। তাঁর অভিজ্ঞতায় জেগে-থাকা পঞ্চাশ-ষাট দশকের আশ্রমজীবনের প্রতিচ্ছবিই ছাতিমতলার গান (সিগনেট, ২৫০.০০)। রবীন্দ্রনাথের আমল থেকে আশ্রমের যে জীবনচর্চা, সেই ধারাবাহিকতাতেই সুব্রত নিজের স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করে দিয়েছেন বইটিতে। ভূমিকা-য় সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ‘খোলা আকাশের নীচে, উদার প্রকৃতির আনন্দময় পরিবেশে, শিক্ষার্থী আর শিক্ষকের নিবিড় সাহচর্যে আশ্রম-বিদ্যালয়ের যে অনন্য রূপ— তার নিপুণ ছবি এঁকেছেন লেখক।’ বিদ্যালয় জীবনের পাশাপাশি লেখকের কলমে ফুটে উঠেছে সাহিত্যসভা, উৎসব অনুষ্ঠান, বর্ষশেষের প্রার্থনা, প্রকৃতিপাঠ চর্চা ইত্যাদি নানা অনুষঙ্গ। যেমন, ‘পাঠভবনে থাকতে মেঘলা দিনে বেড়াতে যাবার মজাটাই আলাদা। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির ছোট-বড় সবাই একসঙ্গে দল বেঁধে যাওয়া। ঠিক যেন একঝাঁক মৌমাছি গান গাইতে গাইতে আনন্দে উড়ে চলেছে। দাঁড়াবার সময় নেই। ডাঙা, খোয়াই, লালমাটির রাস্তা পেরিয়ে চলেছে নতুন বাসার সন্ধানে। একবার গোয়ালপাড়ায় কোপাই নদীর পাড়ে জড়ো হলাম।... শৈশবজীবনের সেসব সোনালি দিন ভোলার নয়।’ পরিশিষ্টে শান্তিনিকেতন থেকে প্রকাশিত ‘আমাদের লেখা’য় ঠাঁই পাওয়া কমবয়সিদের কোনও-কোনও রচনার পুনর্মুদ্রণ— নয় বছরের প্রমথনাথ বিশী, তেরো বছরের অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বা চোদ্দো বছরের শ্যামলী খাস্তগীরের। আছে সুব্রতরও ‘পৌষমেলার স্মৃতি’, তবে তা বেরিয়েছিল ‘খোয়াই’ পত্রিকায়। ফেলে আসা দিনগুলির দুর্লভ সব ছবি, তাতে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গাঁধী, চৌ এন লাই, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শৈলজারঞ্জন, শান্তিদেব ঘোষ, ক্ষিতিমোহন সেন... কেউ বাদ নেই!

গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক অবধি, এখনও নিয়মিত কবিতা লেখার পাশাপাশি কখনও কাব্যনাটক, কখনও বা গদ্যকাহিনি লিখে চলেছেন কৃষ্ণ ধর। আর সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কলাম কে না চেনে! সেই সূত্রেই তাঁর আত্মজৈবনিক রচনাদি একত্র হয়ে বেরল আটদশক সাতকাহন (প্রতিভাস, ৩৫০.০০)। ধারাবাহিক ভাবে দশকের পর দশক ধরে ব্যক্তি সমাজ ও সংস্কৃতির নিহিত সত্যগুলি তাঁর নিবিড় বিবরণে সুচারু গদ্যে গ্রন্থিত। শুরুতেই জানিয়েছেন, ‘তাঁদের কথাই বলতে চেষ্টা করেছি যাঁদের সান্নিধ্য ও সহমর্মিতা আমার জীবনচর্যাকে সমৃদ্ধ করেছে।’ সেখানে ‘প্রথম বিদেশ যাত্রা: মস্কো-বার্লিন’ বা ‘বেরটোল্ট ব্রেখটের থিয়েটারে’ যেমন লিখেছেন কৃষ্ণ ধর, তেমনই লিখেছেন ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র পাঠ’ নিয়ে। লিখেছেন ‘কবিতা সিংহ, কেয়া চক্রবর্তী’কে নিয়েও: ‘বাংলা ভাষায় নারীত্বের স্বাভিমান অনেক কবির কলমে সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কবিতা সিংহকে তাদের পূর্বসূরি বলতে আমার দ্বিধা নেই... কবিতা সিংহের অনুরোধে একটি কাব্যনাটক তাঁকে দিই। নাটকটির নাম বনজ্যোৎস্না। সেটি একক কণ্ঠে বেতারে অভিনয় করেছিলেন কেয়া চক্রবর্তী। তাঁর অভিনব উপস্থাপনায় সেদিন চমকিত হয়েছিলাম।’

Advertisement

নানা ধরনের মানুষ, জীবনের পথে হেঁটে যাওয়ার সময় কত-না আলোছায়া তাদের মুখের ওপর এসে পড়ে। ফিরে তাকিয়ে সে সব নিয়ে লিখবার জন্যে কেউ যখন কলম তুলে নেন, তখন তা হয়ে ওঠে স্মৃতিচিত্রশালা। মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের আন্তরিক পর্যটনে (কারিগর, ২৬০.০০) তেমনই এক বই। ‘প্রকৃতপক্ষে এই বইটির নাম হওয়া উচিত ছিল ‘একা এবং কয়েকজন’... বন্ধুদের বাদ দিয়ে শক্তিকে আলাদা করে ভাবা যায় না। আমরা শুধু নিজেরা আলাদা করে সংসার করিনি, শক্তির যে বন্ধুরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের ছোটো সংসারে স্থান করে নিয়ে সংসারটিকে বড়ো করেছিলেন সেখানে বৈচিত্র্য এনেছিলেন, ভালোবেসে আমাদের আপনজন হয়ে উঠেছিলেন... সেই সব তিক্ত মধুর দিনগুলির স্মৃতি আজ শুধুই ছবি, কিন্তু ‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি’।’ ভূমিকা-য় লিখেছেন শক্তির সহধর্মিণী, আর যে সব ছবি এঁকেছেন তার একটি: ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে স্বাতী-সুনীল আমাদের কাছে ধরা পড়ে গেল। ধরা পড়লাম আমরাও। হ্যাঁ তখন একে ধরাপড়াই বলা হত, প্রেমটা অত স্মার্ট ব্যাপার ছিল না। একটু লুকিয়ে রাখা ব্যাপার ছিল। স্বাতী তো বটেই, সুনীলও একটু লাজুক হল। একটা কোকিল তখন ডাকছিল... ১৯৬৭ সালে ওরা বিবাহিত হল। আমরাও।’

বুদ্ধদেব ও প্রতিভা বসুর কবিতাভবন তো কেবল তাঁদের দক্ষিণ কলকাতার বাসভবন ছিল না, কবিদের তীর্থভূমি হয়ে উঠেছিল। তাঁদের নাতনি কঙ্কাবতী দত্ত আবার প্রণব মুখোপাধ্যায় ও তাঁর প্রয়াত স্ত্রী শুভ্রার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছেন। ভারতীয় গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপতিভবনকে কবিতাভবনের সঙ্গে এক উষ্ণ সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় বেঁধেছেন কঙ্কাবতী তাঁর কবিতাভবন থেকে রাষ্ট্রপতিভবন-এ (প্রিয়া বুক হাউস, ৪০০.০০)। সঙ্গে এ-বইয়ে প্রভাতকুমার দাস কবিতাভবনের পরিচিতি লিখেছেন, পৃথ্বীরাজ সেন লিখেছেন রাষ্ট্রপতিভবনের। কবিতাভবনের পারিবারিক চিঠিপত্রও ঋদ্ধ করেছে বইটিকে, অবশ্যই দুর্লভ সব ছবিও, যেগুলি দেখতে-দেখতে ছুঁয়ে ফেলা যায় সেই সময়টাকে। সর্বোপরি কঙ্কাবতীর স্পন্দ্যমান গদ্য— একাধিক ও দ্বিভাষিক, পাঠককে টেনে নিয়ে যায় কবিতাভবন ও রাষ্ট্রপতিভবনের অন্দরমহলে।

ইতিহাসের প্রতি দায়বোধ বা তার ঠিক-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করার তাগিদ থেকেই কলম ধরেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত। দেশভাগের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাঁর কোথাও মনে হয়েছে, দেশভাগের পরে তা নিয়ে বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যা লিখেছেন, তাতে সে সময়কার ঘটনার সঙ্গে তাঁদের বিশ্লেষণের বৈপরীত্য অনেক জায়গাতেই স্পষ্ট। ফলত প্রকাশ পেয়েছে সুখরঞ্জনের শেষ পারানির কড়ি (দীপ, ১৫০.০০)। ‘আমি আমার সেই চিন্তা ও অনুভূতির তাড়নায় চালিত হয়েই এই কাজে হাত দিয়েছি দেশভাগের শেষ প্রজন্মের একজন মানুষ হিসাবে।’, বইটির ভূমিকা-য় জানিয়েছেন লেখক। তাঁর দেশভাগজনিত বিশ্লেষণে জড়ো হয়েছে বেশ কিছু স্মৃতিও, বিশিষ্ট কোনও কোনও মানুষ সম্পর্কে, তা ওই বিশ্লেষণকে শুধু গাঢ়ই করেনি, বঙ্গদেশের ইতিহাসে বাঙালির স্থানও নির্দিষ্ট করেছে।

‘দেশভাগ থেকে অস্থিরতা। মানুষের মনে শান্তি নেই। উৎসব আনন্দের সুর কেটে গেছে। ফসল ওঠার পরে গ্রামে গ্রামে যাত্রা, জারি, সারি, কবিগানের আসর বসত। মুনিগঞ্জ কালীবাড়ির মেলা, কুদির বটতলার মেলা, সপ্তাহব্যাপী কীর্তনের আসর সব কিছুতেই ভাঁটা। ১৯৫৮ সাল থেকে দেশে সামরিক শাসন চলছে। আইয়ুব খান সর্বেসর্বা।’ লিখেছেন উমা বসু তাঁর (১৯২৮-২০১৪) আত্মস্মৃতি বিপন্নকালের ভেলা-য় (গাঙচিল, ২০০.০০)। পরাধীন খুলনায় জন্মানো উমা একের পর এক রাষ্ট্রীয় ঝড়ঝাপটা সামলেছেন বীরাঙ্গনার মতোই। এ বইয়ের সম্পাদক ঝর্ণা বসু জানিয়েছেন ‘‘উমা বসুর ‘বিপন্নকালের ভেলা’ শুধুমাত্র একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কালের অন্যতম বিশ্বস্ত দলিল নয়, মর্মবস্তুর দিক থেকে দেশভাগের স্বাধীনতার কালাতিক্রমী দর্পণ।’’

দেশভাগের ধাক্কায় ছিন্নমূল এক পরিবারের মেয়ে নীলা দত্ত। নিজের দীর্ঘ জীবনে পরিবারের পাশাপাশি দেশ ও সমাজে যে নির্মমতা দেখেছেন, সে সবের সঙ্গে মুছে যাওয়া সময়ের ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন ছিন্নমূলের ডায়েরি (ঋত প্রকাশন, ১০০.০০)। স্মৃতিকথার শেষে তাঁর স্বামী যতীশচন্দ্র দত্তের ছোটদের জন্যে লেখা কিছু কবিতাও আছে। এই গদ্যপদ্যের সমাহারে প্রবেশের আগে অবশ্যপাঠ্য গোপা দত্তভৌমিকের কথামুখ: ‘মধ্যবিত্ত সংসারের এক মানবী বিংশ শতাব্দীর বিক্ষুব্ধ দেশকালের মধ্যে কীভাবে বড়ো হয়ে উঠেছে, সেই গল্প একজনের হয়েও হয়তো অনেক জনের।’

দেশভাগের অভিঘাতে লেখা শান্তা সেনের ‘পিতামহী’ ও ‘জন্মের মাটি’ উপন্যাস দু’টি এক মলাটে গ্রন্থিত হয়েছে— জন্ম ও জন্মান্তর (গাঙচিল, ৪০০.০০)। কেন এই লেখা, তাতে শান্তা জানিয়েছেন ‘যদি এই দেশ দু-টুকরো হয়ে না যেত, দীর্ঘকাল তোলা হয়ে না থাকত নিষেধের পাঁচিল, তা হলে কি এত অনিবারণীয় হতো এই টান? বিচ্ছেদেই সে আরো বেশি আপন হয়ে ওঠে।’

আরও পড়ুন
Advertisement