অসুস্থ হওয়ার আগে পড়া শেষ বইটির কথা জানিয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি
Pranab Mukherjee

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পড়া শেষ বই কোনটি?

বইটি পাঠক সমাজে সমাদৃত, লেখকমহাশয় তো বটেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৫:৫৬

প্রথম আলো
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১০ (অখণ্ড)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমার প্রিয় পাঠ্যবিষয়। ইংরেজি অনুবাদে (কখনও বাংলাতেও) বহু লেখকের গ্রন্থ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে এর উপর। কখনও নতুন তথ্যের উপর আলো ফেলা ইতিহাস, বা সে সময়ের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নানাবিধ জার্নালের সঙ্কলন। এ ছাড়া ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাসও কম হাতে আসেনি। এ কথা আজ বলতে আপত্তি নেই যে, ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় লেখকদের গবেষণায় যেন কোনও শ্রান্তি নেই। বস্তুগত তথ্যের যতটা সন্নিকটে যাওয়া সম্ভব, তাঁরা খুঁড়তে খুঁড়তে সেখানে পৌঁছন। কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার আগে তাঁরা অনেক পথ পাড়ি দেন। আরও একটি বিষয় দেখেছি, মৌলিক তথ্যাদির ক্ষেত্রে কোনও নিজস্ব ব্যাখ্যা বা মতামত ইউরোপীয় লেখকরা সচরাচর দেন না। সেটি পাঠকের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। বা, বলা ভাল ওই মৌলিক তথ্যকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে ইতিহাস নিজের ভাঁজ খুলতে থাকে। ইতিহাস-আশ্রিত ঘটনা বা কাহিনিগুলিও এগোতে থাকে। আর্ভিং ওয়ালেস-এর দ্য সেকেন্ড লেডি উপন্যাসটির কথা প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে গেল। যেখানে কাল্পনিক একটি স্পাই থ্রিলারের প্লট বোনা হয়েছে আমেরিকা-রাশিয়ার ঠান্ডা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে। এই পরিপ্রেক্ষিত রচনায় কিন্তু কোনও ফাঁকি নেই, পক্ষপাত নেই। সবচেয়ে বড় কথা, সে সময়ের ঐতিহাসিক তথ্যগুলির উপর কোনও অর্থ আরোপ করা বা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা নেই।

Advertisement

এত কথা বলা এই কারণেই যে, সাম্প্রতিক সময়ে আমার পড়ার টেবিলে এবং রাতে বালিশের পাশে থাকা যে বাংলা বইটি একটানা পড়ে শেষ করলাম, সেখানেও এই দুর্লভ প্রসাদগুণের দেখা পেয়েছি। বইটি পাঠক সমাজে সমাদৃত, লেখকমহাশয় তো বটেই। এটি দু’খণ্ডে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলো উপন্যাস। সুনীল আমার পুরনো সুহৃদ, বন্ধুমানুষ। তাঁর অনেক উপন্যাসই আমার পড়া থাকলেও কোনও কারণে প্রথম আলো আগে পড়া হয়নি। এখন পাতা উল্টোতে গিয়ে দেখলাম, উনিশ শতকের ইতিহাস ধীরে ধীরে কী অপূর্ব শৈলীর মাধ্যমে খুলে যাচ্ছে। সেই সময়ের কলকাতা, বাবু কালচার, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজাদের ইতিহাস, সেখানকার জনজাতিদের বৈচিত্র, বিভেদ ও সমাজনীতি, যৌনতা, ঠাকুর পরিবার এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। সুনিপুণ ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে বাংলায় থিয়েটারের গোড়াপত্তনের কথা। সুনীলের ভাষার সাবলীল গতি সম্পর্কে আমি আর নতুন করে কী বলব, এটি বহু-আলোচিত, এবং এ বিষয়ে যাঁরা বিশেষজ্ঞ তাঁরাই ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু এক জন সাধারণ পাঠক হিসেবে এটুকু বলতে পারি, ভাষার গভীরতা, ঐশ্বর্য এবং আলঙ্কারিক দিকটির সঙ্গে এতটুকু সমঝোতা না করেও এমন গতি বজায় রয়েছে এই সুবিপুল উপন্যাসটিতে, কোথাও এক বারের জন্যও তাল কাটে না। বরং পরের পাতায় কখন পৌঁছব তার জন্য তাড়না তৈরি হয়। সংলাপ যেন উনিশ শতকের ইঙ্গবঙ্গ বাবু সমাজের থেকে তুলে আনা, প্রাণবন্ত। আমার এমনও হয়েছে যে, রাতে ঘুমোতে দেরি হয়ে গিয়েছে কোনও কোনও দিন গ্রন্থটির টানে!

প্রথম খণ্ডটি শুরু করেই চমৎকৃত না হয়ে পারিনি। বহু মন্ত্রকে কাজ করার সুবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আদিবাসী মানুষ জনের পাশাপাশি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংস্কৃতি সম্পর্কে হাতে-কলমে ধারণা একটা ছিলই। বহু বার গিয়েছি, সেখানকার মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি, বৈঠক করেছি। তাই সত্যি বলতে কি, একটা শ্লাঘাও মনের মধ্যে কোথাও ছিল এ বিষয়ে। কিন্তু প্রথম আলো-র প্রথম কিছু পৃষ্ঠায় যে গভীর গবেষণায় উত্তর-পূর্বের (তা তখনও ছিল অন্ধকারচ্ছন্ন পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা ব্রিটিশদের বুটের ছাপ থেকে দূরে থাকা প্রায় এক আদিম অস্তিত্ব) প্রায় ১৪টি আদিবাসীর পৃথক পৃথক পোশাক, চেহারা, পেশা, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং প্রবণতার কথা সুনীল উল্লেখ করেছেন, তা আমায় যুগপৎ চমৎকৃত এবং এই বিষয়ে শিক্ষিত করেছে। বিজয়া দশমীর রাতে চন্দ্রবংশীয় ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের প্রথাগত মহাভোজকে সামনে রেখে সেই সময়ের এই প্রদেশ, তার রাজতন্ত্র, রাজনীতি এবং প্রজাদের ইতিহাসকে ধীরে ধীরে উন্মোচন করা হয়েছে। সেই সময়ের যাপনের সঙ্গে অথবা বিভিন্ন মিথ-এর সঙ্গে জড়িত এমন ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা আমার আগে জানা ছিল না। গ্রন্থটির কাছে এ কারণেও ঋণ বাড়ল।

সমান্তরাল ভাবে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির পূজারি রামকৃষ্ণ এবং সিমলে-র নরেন দত্তকে কেন্দ্র করে সেই সময়ের কলকাতা তথা বাংলার ইতিহাস শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে উপন্যাসে। সেই সময়কার বহু চরিত্র নিজেদের মতো করে কথা বলেছে। মজার ব্যাপার হল, দ্বিতীয় খণ্ড তিনি উৎসর্গ করেছেন রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে (ভানু, রবি, রবীন্দ্রবাবু ইত্যাদি)। প্রথম খণ্ডে এমনকি রোববাবু সম্বোধনও দেখা যায়। অর্থাৎ মানুষ রবীন্দ্রনাথের নানা বিশ্বাস্য টুকরোর প্রতিই যে তিনি নিষ্ঠাবান, তা লেখকপ্রদত্ত এই সঙ্কেতের মধ্যে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কাদম্বরী দেবী এবং রবীন্দ্রনাথ, বিনোদিনী এবং গিরিশ ঘোষের সম্পর্ককে স্থাপন করা হয়েছে সেই সময়-সমাজ-সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে। এর ফলে শুধুমাত্র তাঁদের আন্তঃসম্পর্ককেই চিত্রায়িত করা হয়েছে তা-ই নয়, জানতে পারছি সেই সময়ের অভিনেতা মালিকদের জীবন, রবীন্দ্রনাথের একেবারে প্রথম পর্বের লেখালিখি, বাংলা নাটকের ইতিহাস, স্টার থিয়েটারের কথা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর অন্তর্লীন টানাপড়েন-সহ বিভিন্ন আখ্যান, যা সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তী দেশের পূর্ব ভাগের সমাজ-রাজনীতির বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করেছে। আমার মনে হয়, যে কল্পনার আশ্রয় এই বইটি লেখার সময় নিয়েছেন সুনীল, তা সেই বাস্তবকে আচ্ছন্ন করেনি, বরং রক্তমাংসময় করে তুলেছে।

আর তাই, দ্বিতীয় খণ্ডের শুরুতে মধ্যাহ্নের নদীপথে শিলাইদহের কুঠিবাড়ির কাজ সেরে রবীন্দ্র যখন বজরায় করে পাবনা জেলার সাজাদপুরের দিকে যাত্রা করেন, পাঠকও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে মানসভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। গোটা গ্রন্থ জুড়ে এই ইতিহাসের এক নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা চলতেই থাকে।

অনুলিখন: অগ্নি রায়

(গত ৬ অগস্ট, বৃহস্পতিবার, ১০ রাজাজি মার্গে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়ে তাঁর তখনও পর্যন্ত শেষ পড়া বইটি সম্পর্কে এই লেখাটি সংগ্রহ করা হয়। উনি ডিকটেশন দেন, লিখে নেওয়া হয়। ৯ তারিখ তিনি অসুস্থ হন এবং তার পরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। লেখাটি মুদ্রিত হলেই তাঁকে জানাতে বলেছিলেন। তা না জানাতে পারার আপশোস যাওয়ার নয়।)

আরও পড়ুন
Advertisement