পুস্তক পরিচয়২

রবীন্দ্রসৃষ্টিকে বিচিত্র প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি মানে শুধুই যে রবীন্দ্রনাথ, তা তো নয়। বৃহৎ পরিবারটি নানা জ্ঞানী-গুণিজনদের আখড়া। সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে যেমন বহুবিধ চর্চা এবং প্রয়োগকৌশল ছিল, তেমনই সমাজের অবহেলিত দিকগুলির প্রতি ছিল সমান নজর। স্ত্রীশিক্ষার গুরুত্বের প্রতি রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, ক্ষেমেন্দ্রনাথ, জ্ঞানদানন্দিনী, স্বর্ণকুমারী, ইন্দিরা, সরলা দেবীরা সকলেই কলম ধরেছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি মানে শুধুই যে রবীন্দ্রনাথ, তা তো নয়। বৃহৎ পরিবারটি নানা জ্ঞানী-গুণিজনদের আখড়া। সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে যেমন বহুবিধ চর্চা এবং প্রয়োগকৌশল ছিল, তেমনই সমাজের অবহেলিত দিকগুলির প্রতি ছিল সমান নজর। স্ত্রীশিক্ষার গুরুত্বের প্রতি রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, ক্ষেমেন্দ্রনাথ, জ্ঞানদানন্দিনী, স্বর্ণকুমারী, ইন্দিরা, সরলা দেবীরা সকলেই কলম ধরেছিলেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা তাঁদের প্রবন্ধগুলি একত্র করেছেন প্রত্যুষকুমার রীত স্ত্রীশিক্ষা ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি (প্রতিভাস) গ্রন্থে। ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় পরিবারের সদস্য ছাড়াও অন্য লেখকদের স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক রচনার তালিকা পরিশিষ্টে যোগ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সম্পাদকদের প্রতি লেখা চিঠি ছাড়াও গ্রন্থ-সম্পাদক ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় এই বিষয়ক লেখার তালিকা যোগ করেছেন। প্রত্যুষকুমারের আর একটি সংকলন ঠাকুরবাড়ির পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণ কথা (অলকানন্দা পাবলিশার্স) জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস প্রসঙ্গে মূল্যবান সংযোজন। এটি নির্বাচিত রচনার সংকলন।

বেদানুশীলনে জোড়াসাঁকো ঠাকুরপরিবার গ্রন্থটি ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন সদস্যের বেদ চর্চার তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা এবং তালিকা। বলা বাহুল্য, সংকলনের সিংহভাগই জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের এই বইটি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বেদবিদ্যা কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত।

Advertisement

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র প্রসঙ্গে প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ পুস্তিকাকারে প্রকাশ করেছে সূত্রধর প্রকাশনী। দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত সংকলিত ভগিনী নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিবেদিতার জীবনাবসানের পর জগদীশচন্দ্র বসুর অনুরোধে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্র-প্রবন্ধ এবং নিবেদিতার দ্য ওয়েভ অব ইন্ডিয়ান লাইফ গ্রন্থের কবিকৃত ভূমিকার অনুবাদ। রবি-রঙ্গী রঙ্গমঞ্চ দেবজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়; রঙ্গমঞ্চের মননে রবীন্দ্ররচনা ‘রঙ্গমঞ্চ’ ছাড়াও গাঁথা হয়েছে রবি-পরম্পরায় অনুগামী শিশিরকুমার ভাদুড়ি, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, অহীন্দ্র চৌধুরী, মধু বসু এবং নরেন্দ্র দেবের নাটক বিষয়ক রচনা। লেখাগুলির উৎস থাকলে ভাল হত। রেকর্ডে রবীন্দ্রগান (১৯০১-১৯৪১) জয়তী গঙ্গোপাধ্যায়ের কয়েকটি পূর্বপ্রকাশিত প্রবন্ধের গ্রন্থরূপ। রবীন্দ্রসংগীতের বিভিন্নতার আলোচনা ছাড়াও রেকর্ড তৈরির ইতিহাস সংকলনটির মর্যাদা বাড়িয়েছে। পুনর্মুদ্রিত হয়েছে প্রফুল্লকুমার সরকারের জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ। মূল্যবান গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশের তথ্যগুলি জরুরি ছিল। রবীন্দ্র-উপন্যাস শেষের কবিতা-র নিঃশব্দ নায়ক শোভনলাল। উপন্যাসের চিত্রপটে একপাশে সরে থাকা শোভনলালের ছায়াপথটি অনুসরণ করে অঞ্জন চক্রবর্তীর শেষের কবিতার শোভনলাল। রবীন্দ্রসাহিত্য আলোচনায় একটি ব্যতিক্রমী চিহ্ন।

রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত সাময়িক পত্রিকাগুলি পাঠককেও উজ্জীবিত করেছিল কলম ধরতে। ‘সম্পাদক-রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে তাঁর সম্পাদিত সাময়িকপত্রাদিতে আপন-আপন চিন্তা চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন’ যাঁরা, কবি-সম্পাদিত পত্রিকাগুলি থেকে এ রকম দুশো ছত্রিশ জন পাঠককে চিহ্নিত (অজ্ঞাত সহ) এবং তাঁদের পরিচয় তালিকাবদ্ধ করেছেন শুভাশিস মণ্ডল সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের লেখকরা (এবং মুশায়েরা) গ্রন্থে।

রবীন্দ্রনাথের সময়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলা পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত কবির কবিতা-গান-উপন্যাস-ছোটগল্প-নাটক-প্রবন্ধ। সমকালে নানা স্বল্পায়ু পত্রিকাও যাত্রা শুরু করেছে কবির ছন্দোবদ্ধ অভিনন্দনবাণীর তিলক ললাটে এঁকে। ব্যতিক্রম বোধহয় ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকাটি, ১৩২০ আষাঢ়ে প্রকাশিত হলেও রবি-বাণীর জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল তেরো বছর। প্রথম রবীন্দ্র-কবিতা কবির হাতের লেখায় ছাপা হয়েছিল ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যায়। যৎসামান্য হলেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রসাদ থেকে বঞ্চিত করেননি ‘ভারতবর্ষ’-কে। রবীন্দ্রনাথ ও ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পর্কের পূর্ণাঙ্গ তথ্য কবির রচনা এবং কবি-বিষয়ক রচনা একত্র করেছেন পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতবর্ষ-র রবীন্দ্রনাথ (পত্রলেখা) গ্রন্থে।

বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথকে দেখা রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড হিজ সার্কল (সম্পা: তপতী মুখোপাধ্যায় ও অমৃত সেন, রবীন্দ্র ভবন, বিশ্বভারতী) গ্রন্থটি ষোলোটি প্রবন্ধের সংকলন। বিশিষ্ট জনেদের মধ্যে নয় জন বিদেশিকে পাওয়া যাচ্ছে। ভারতীয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সকলেই বঙ্গবাসী, ব্যতিক্রম শুধু গাঁধী। বলতে গেলে, আলোচ্য বিষয় হিসেবে কোনওটাই নতুন নয়। মার্টিন কেম্পশেন-এর ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড অ্যালেক্স অ্যারনসন’ প্রসঙ্গ বেশ একটি সম্পূর্ণতা পেয়েছে। প্রত্যেকটি শিশুকে অন্তরে নিজস্ব চেতনার আলোকে দেখা ও তার ব্যক্তিত্বকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথ এবং মারিয়া মন্তেসরি এই দুই ব্যতিক্রমী শিক্ষাবিদের অবদান ‘অ্যান এনকাউন্টার বিটুইন এডুকেশনাল পাইয়োনিয়ার্স: রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড মারিয়া মন্তেসরি’ প্রবন্ধটির বিষয়। পারস্পরিক চিঠিপত্র আদান-প্রদান ও তাঁদের প্রবন্ধের আলোচনা লেখাটিকে প্রাণবন্ত করেছে। লেখক ক্যাথলিন এম ও’কনেল।

‘অস্পষ্টতা কাটানোর জন্য নাম বদলে হল’— রবীন্দ্রনাথ ও কুইনী এবং অন্যান্য (শুভম বুকস), বর্তমান সংস্করণে জানিয়েছেন লেখক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য। প্রথম সংস্করণের লেখাগুলির সঙ্গে একটি নতুন নিবন্ধ যোগ হয়েছে এই সংস্করণে: ‘দিনেন্দ্রনাথ ও অমলা তরুণী ওরফে কুইনী’। এ ছাড়াও পরিশিষ্টে ‘কুইনীর বিয়ে’, আর রবীন্দ্রনাথের মূল্যবান বেশ কিছু চিঠির প্রতিলিপি ও অন্যান্য নথিপত্র। কেন্দ্রে কবিকে রেখে, তাঁর সঙ্গে চেনা-অচেনা নানা ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বকে জড়িয়েই রচিত এ-বই।

জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন দিকে, নতুন থেকে নতুনতর দর্শনে যে ভাবে কবি স্বমহিম হয়ে উঠতেন, তাতেই চেনা যেত রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিকতার বোধ। কেবল শিল্প-সাহিত্যই নয়, শিক্ষা ও বিজ্ঞানচিন্তা, চিত্রশিল্প ও অনুবাদ, নৃত্যভাবনা বা এরকম আরও বহুবিধ বিষয়ে কী ভাবে ছেয়ে থাকত কবির মন ও মননের জগৎ, তা নিয়েই বিশিষ্ট জনের রচনায় ঋদ্ধ রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ (সম্পা: আলপনা রায় অমল পাল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী)।

এবং মুশায়েরা-র (সম্পা: সুবল সামন্ত) ‘রবীন্দ্র-গ্রন্থ-সপ্তক শতবর্ষ সংখ্যা’-য় বিভিন্ন প্রাবন্ধিকের রচনা কবির ফাল্গুনী, বলাকা, চতুরঙ্গ, ঘরে বাইরে, গল্পসপ্তক, পরিচয়, সঞ্চয় ইত্যাদি নিয়ে। এই সময়ের প্রেক্ষিতে নতুন দৃষ্টিকোণে। শতবর্ষ আগে গ্রন্থিত রবীন্দ্রসাহিত্যের নানা বর্গের মধ্যে একটি অন্তর্লীন সূত্র খোঁজার প্রয়াস।

আরও পড়ুন
Advertisement