পুস্তক পরিচয়১

ছিন্নমূল গৃহশ্রমিকদের কথা

সপ্তদশ শতকের প্রথম দশক থেকে ইউরোপীয় সাহিত্যের পাঠক জেনে গিয়েছেন প্রভু আর ভৃত্যকে যদি একসঙ্গে পথ চলতে দেওয়া হয়, তাঁরা পথ চলার কড়ি হিসাবে শুধু যে আখ্যান বুনবেন তা নয়, তাঁদের কথোপকথনে অবিসংবাদিত ধরা থাকবে দার্শনিক যুক্তি-তর্কের দুই বিপ্রতীপ অবস্থান।

Advertisement
রঙিলী বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০৮

সপ্তদশ শতকের প্রথম দশক থেকে ইউরোপীয় সাহিত্যের পাঠক জেনে গিয়েছেন প্রভু আর ভৃত্যকে যদি একসঙ্গে পথ চলতে দেওয়া হয়, তাঁরা পথ চলার কড়ি হিসাবে শুধু যে আখ্যান বুনবেন তা নয়, তাঁদের কথোপকথনে অবিসংবাদিত ধরা থাকবে দার্শনিক যুক্তি-তর্কের দুই বিপ্রতীপ অবস্থান। দন কিহোতে-র গল্পকাঠামোয় ‘ভৃত্যের’ এই অবিরত প্রতিযুক্তি নির্মাণের উচ্চকিত বা কখনও-সখনও নীরব-অন্তর্লীন প্রক্রিয়াকে সেরভেন্তেস-উত্তর ইউরোপীয় ঔপন্যাসিকরা নিজেদের কাহিনি গঠনের একদম অন্তরঙ্গ প্রকরণ হিসাবে নিলেন। আরও বহু কিছু নিলেন তাঁরা— সেরভেন্তেসের কাছে আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের ঋণ অদ্যাবধি অনির্বাপিত; কিন্তু আমরা এখানে একটা বিশেষ বয়ানকে আলাদা করে বলছি, যা ঐতিহ্যবাহী লোকগাথা-রূপকল্প-প্রাত্যহিকের অনুষঙ্গকে আনছে (প্রায়শই, ভৃত্যের) গল্প বলে যাওয়ার চৌহদ্দিতে। দনি দিদরোর ‘জাক দ্য ফাতালিস্ত’ (১৭৯৬) যেমন— যাত্রাপথে জাক যে শুধু গল্প বলে তাই নয়, তার কাছে গল্প শুনতে চাওয়া প্রভুর চেয়ে তার মেধা যে অনেক বেশি তার কখনও প্রচ্ছন্ন, কখনও প্রগাঢ় ইঙ্গিত থাকে উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে। অনেকাংশে একই বাক্‌ভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন অবস্থানে উপস্থিত হতে দেখি দিদরোর প্রায় সমসাময়িক পিয়ের বোমার্শের ১৭৭৮-এ লিখিত ‘মারিয়াজ দ্য ফিগারো’-তে। ১৮৭৭ সালে গুস্তাভ ফ্লোবেয়ার ‘লে ত্রোয়া কঁৎ’ বা ‘তিন গল্প’-এর প্রথম গল্প ‘অ্যাঁ ক্যর স্যাম্‌প্ল’-তে পরিচারিকা ফেলিসিতের কোমল আবেগঋদ্ধ মন গৃহকর্ত্রীর বাড়ি, মানুষজন, উত্তরাধিকারে পাওয়া তোতাপাখি, এমনকী বাসস্থান নর্মঁদির প্রকৃতির মধ্যে যে ভাবে নিয়োজিত তার এক অসামান্য বিবরণ দেন আমাদের। মৃত্যুমুহূর্তে ফেলিসিতের আধ্যাত্মিকতাবোধে যে ভাবে আত্মীকৃত হয় তোতাপাখির নকল অবয়ব, তাতে আবারও বাকি সব চরিত্রের তুলনায় তার চিন্তার পরিসরকে বৃহৎ বিপুল মনে হয়। কাহিনির নিশ্চয়তাকে ধ্বংস করতে, গল্পের নিটোল একমাত্রিকে ছেদ নামিয়ে আনতে ‘ভৃত্য’-চরিত্র এক বহুদর্শী সন্তের ভূমিকাই যেন পালন করে এসব আখ্যানে।

প্রভু-ভৃত্যের এই ধ্রুপদী বয়ানের একটা অন্য দিক প্রতিনিয়তর অন্দরে, গার্হস্থ্যের গর্ভে এই সম্পর্কের গল্প-বুনন। যেখানে আখ্যান সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক আকার সন্ধান করে চলে। চল্লিশ দশকের শেষের দিকে নরেন্দ্রনাথ মিত্র ‘দ্বিচারিণী’ বা ‘অবতরণিকা’র মতো লেখায় আমাদের শোনাচ্ছেন পরিবারের বাইরের নানা সম্পর্ক পরিচারিকার চরিত্রটিকে ঘিরে কী ভাবে আবর্তিত হচ্ছে অথবা তার উপস্থিতি অন্দরের দ্রুত-পরিবর্তনশীল, স্বতঃ-অনিশ্চিত এবং ক্রম-অপস্রিয়মাণ নানা পরিসরে কী ভাবে জায়গা করে নিচ্ছে। পরিচারকের সঙ্গে গৃহস্থ-কন্যার সম্পর্কের জটিলতাকে তিনি আনছেন লেখায়— সুনির্দিষ্ট শ্রেণিবিন্যাস অতিক্রম করা গেরস্থালি তাঁর কাহিনিতে উঠে আসছে বারংবার। সুলেখা সান্যাল, সাবিত্রী রায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সন্তোষকুমার ঘোষ, দিব্যেন্দু পালিত, রমাপদ চৌধুরী, মহাশ্বেতা দেবীর নানা সময়ের গল্প-উপন্যাসে এমন শ্রমবিনিময়ের, সম্পর্কের, সম্পর্কহীনতার আখ্যান শুনেছি আমরা। অন্য দিকে, স্মৃতিকথায় বা অন্য টুকরো গদ্যে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, কল্যাণী দত্ত, সুধাংশুবালা সরকার, প্রমীলা দেবীরা লিখে রাখছেন পরিবারের অন্দরে ভৃত্য জীবনযাপনের অসম্মান-অনাদর বা বহু সময় ভালবাসারও কাহিনি। নিজের জীবনে দাসত্বের, অনটন-অপমানের গল্প কথিত আছে সুমিত সরকার উল্লেখিত ‘হরিদাস পালিত’-এর লেখা বঙ্গীয় পতিত জাতির কর্ম্মী।

Advertisement

ঊনবিংশ শতকের শেষ, বিংশ শতকের শুরুতে জাতীয়তাবাদী সংবাদ ও সাময়িকপত্রগুলি যখন ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করে চলেছে বিদেশি শাসকের অধীন শ্রমিকদের হত্যা এবং তা নিয়ে ঔপনিবেশিক বিচারের প্রহসনের বিবরণ, ব্রিটিশ শাসক চাপের মুখে মালিকের অধিকার সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে উদ্যত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতো লেখকরা সে সময় শাসিত মধ্যবিত্তের মধ্যেই শাসকের দুর্গুণ চারিত হওয়ার লক্ষণ দেখছেন গৃহের অন্দরে পরিচারকদের সঙ্গে ব্যবহারের মধ্যে, আত্মবীক্ষার ভঙ্গিতে উঠে আসছে রবীন্দ্রনাথের একাধিক গল্প এবং অন্য রচনা, প্রসন্নময়ী দেবীদের স্মৃতিকথা। মন্বন্তর, দাঙ্গা এবং পঞ্চাশ-ষাটের দশকে দেশভাগ-জনিত শরণার্থীর ভিড় পশ্চিমবঙ্গে গৃহশ্রমের মূল্য-অবনমনকে এক নতুন মাত্রা দিল, কারণ, অবশ্যই শুধু গৃহশ্রম নয়, অন্য অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রম-সরবরাহের অতর্কিত ও অস্বাভাবিক হারবৃদ্ধি। সত্তর দশকের শেষাশেষি থেকে পশ্চিমবঙ্গে ভূমিসংস্কার এবং কৃষিক্ষেত্রে খানিকদূর পরিকাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পরেও আশির দশকের কৃষিউৎপাদন বৃদ্ধির সুফলবন্টন ছিল অসম। ভূমিসংস্কার-পরবর্তী সময়ে মধ্যবর্গীয় কৃষকের উত্থান এবং প্রজাস্বত্ব সংস্কারের উপকৃত মানুষের মধ্যে মহিলাদের কম উপস্থিতি এর অন্যতম দুটি কারণ যার প্রভাব অনেকাংশে পড়েছিল গৃহশ্রমিক, বিশেষত, মহিলা শ্রমিকদের উপর।

শরণার্থী হিসাবে আসা অথবা অন্য পরিযায়ী শ্রমিক বিশেষত, ছিন্নমূল মহিলা ও মেয়ে শিশুশ্রমিকদের উদ্ভব, উৎপত্তি এবং জীবনযাপনের অর্থনৈতিক-ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক এই প্রেক্ষিতকে ধরতে চেয়েছেন দীপিতা ও ঈশিতা চক্রবর্তী। সে কাজে সংবাদপত্রের মহাফেজখানা, বাংলা সাহিত্য ও গবেষণাধর্মী রচনা, সমাজতাত্ত্বিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের তত্ত্বায়ন সব কিছুকেই কাজে লাগিয়েছেন তাঁরা। চমৎকার ব্যবহার আছে একটি অধ্যায়ে দেশভাগ-পরবর্তী পর্বে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনগুলির। তাতে ছিন্নমূল পরিচারিকাদের অগ্রাধিকার এবং বয়স ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ সেই সময়ের বাঙালি মধ্যবিত্তের নির্বাচন, অভিরুচি, সুবিধাভোগী শ্রেিণ-অবস্থানকে যে ভাবে প্রতিফলিত করছে তাকে প্রাক্‌-স্বাধীনতা পর্বের সঙ্গে তুলনা করছেন তাঁরা যখন বহু বাঙালি পরিবারের অন্দরে কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল অন্য রাজ্যের, বিশেষত বিহার ও ও়ড়িশা থেকে আগত পুরুষ গৃহশ্রমিকদের ওপর। অমর্ত্য সেনের পরিবারের মধ্যে ‘সহযোগিতামূলক দরাদরির’ তাত্ত্বিক কাঠামোকে ব্যবহার করে বীণা আগরওয়াল যে পদ্ধতিতে মন্বন্তরের সময় বহু মেয়ে এবং শিশুর পরিত্যক্ত হওয়ার ঘটনাকে বিশ্লেষণ করেন, দীপিতা ও ঈশিতা ক্রমান্বিত অনাহারক্লিষ্ট পরিবারের মেয়েশিশুদের ভিন্ন মাত্রার সংকট ও বাধ্যতামূলক কর্মজীবনে ঢোকার ব্যাখ্যা গড়তে গিয়ে তাকে প্রয়োগ করতে চান তাঁদের সংগৃহীত প্রাথমিক সাক্ষ্য ও অন্য তথ্যগুলিকে মাথায় রেখে ।

সে অর্থে কাজটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য এবং প্রয়াস প্রশংসনীয়। যদিও সন্দেহ থেকে যায় তাঁদের পদ্ধতিগত এবং উপস্থাপনার দিক প্রসঙ্গে। এক, বইটির নামকরণ দেখে মনে হয় এটা সমস্ত ভারতের প্রেক্ষিতে একটা আলোচনা, কিন্তু বইতে মূলত আলোচনা হয় পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে, যে দু-একটি জায়গায় অন্য রাজ্যের কথা আসে তা সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের একটা তুলনামূলক আলোচনার খাতিরে।

দুই, অনেক ধরনের পদ্ধতির ব্যবহার এই জাতীয় বিশ্লেষণকে গাঢ়তা দেয় ঠিকই, কিন্তু তার থেকে একটা নিজস্ব পদ্ধতিপথ উঠে আসা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, না হলে যুক্তিতর্ক বিন্যাসের পরিসর ক্রমে অগোছালো হয়ে ওঠে, এ বইতে তা বারবার হয়েছে, অধ্যায়গুলো একে অন্যের দিকে সহজ ভাবে এগোয়নি, বরং আলাদা আলাদা লিখিত হয়ে বইতে একটা সংগ্রহের আকার নিয়েছে, এমন মনে হয়। তিন, পাণ্ডুলিপি-সম্পাদনাতে ত্রুটি থেকে গিয়েছে বহু। তবু একটা বৃহত্তর আখ্যানের মধ্যে তাঁরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অর্থনৈতিক ও সমাজজীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের। আশার কথা, এ সময়ে আরও অনেকেই এ দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছেন— ভারত এবং অন্য উন্নয়নশীল দেশের সিংহভাগ মানুষ অন্নের জন্য যে ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল, যত শোষণমূলকই হোক তা— তাকে নিয়ে গবেষণা অর্থনীতিকদের সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও করবেন, এটাই কাম্য।

উইমেন, লেবার অ্যান্ড দি ইকনমি ইন ইন্ডিয়া: ফ্রম মাইগ্র্যান্ট মেনসার্ভেন্টস টু আপরুটেড গার্ল চিলড্রেন মেডস। দীপিতা চক্রবর্তী ও ঈশিতা চক্রবর্তী। রাটলেজ, মূল্য অনুল্লেখিত

আরও পড়ুন
Advertisement