গুরু গোবিন্দের জন্মস্থান। হরমন্দির সাহিব, পটনা।
দশম পাদশা কি গ্রন্থ’ বা ‘দশম গ্রন্থ’ মধ্যকালীন পঞ্জাবি সাহিত্যে একটি মূল্যবান সংযোজন। গুরুমুখী অক্ষরে লেখা গ্রন্থটিতে ভারতীয় পৌরাণিক বৃত্তান্ত, শক্তিপূজা, অবতারবাদ, ইত্যাদির উল্লেখের পাশাপাশি ঈশ্বরকে কেবলমাত্র নিরাকার জন্মমৃত্যুহীন রূপে কল্পনা করা হয়েছে। ব্রজভাষার প্রাধান্য থাকলেও, সেখানে ফারসিতে লেখা ‘জাফরনামা’ও স্থান পেয়েছে। গ্রন্থের শব্দভাণ্ডার এসেছে আওধি, আরবি, পঞ্জাবি, ফারসি ও ডিঙ্গল ভাষা থেকে। রচনাশৈলীতে মহাকাব্যের বিশালতার স্পর্শ থাকলেও, অতি দ্রুত ছন্দের কাব্যিক দ্বিপদী ‘দশম গ্রন্থ’-কে আরও বৈচিত্রময় করেছে। তবে কবে সেটি লেখা হয়েছিল আর তার সব রচনা গুরু গোবিন্দ সিংহের (১৬৬৬-১৭০৮) কি না, তাই নিয়ে মতভেদ কম নেই। কোনও কোনও পণ্ডিত গ্রন্থের সবটাই গুরুর সৃষ্টি বলে মনে করেন। অন্যদের মতে, ১৪২৮ পৃষ্ঠা বিস্তৃত এই গ্রন্থের একটি বড় অংশ গুরুর দরবারের কবিদের লেখা। তাঁরা মনে করেন, প্রথমে কবিরা লেখেন, পরে তাঁরাই আবার সেগুলিকে গুরুর নাম দিয়ে ‘দশম গ্রন্থ’-এ মিলিয়ে দেন।
গত পঞ্চাশ বছরে ইংরেজিতে রাইনহার্ট ও পঞ্জাবিতে জাগি-র রচনা ছাড়া ‘দশম গ্রন্থ’ নিয়ে তেমন কোনও নজরকাড়া গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। জাগি প্রধানত পঞ্জাবি উপাদানের ভিত্তিতে লিখেছেন, অন্য দিকে রাইনহার্টের উদ্যোগ মূলত ‘দশম গ্রন্থ’ সংক্রান্ত তর্কবিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আলোচ্য বইটিতে কেবল প্রাথমিক উপাদানের বিপুল সংগ্রহ ও ব্যবহার দেখি না, দুই গবেষক দশম গুরুর খালসা (১৬৯৯) সৃষ্টির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও চৈতন্য নির্মাণে ‘দশম গ্রন্থ’-এর ভূমিকার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন, যা আগে দেখিনি। দেশবিদেশের শিখরা যখন দশম গুরুর সাড়ে তিনশো বছরের জন্মোৎসব পালন করছেন, তখন এই বইটির প্রকাশ খুব সময়োপযোগী। কিন্তু তার বিষয়বস্তু অবশ্যই বাজার সর্বস্ব নয়। বইটি পশ্চিমের দু’জন শিখ গবেষকের প্রায় দুই দশক বিস্তৃত গবেষণার মূল্যবান ফসল। ভূমিকা, গ্রন্থপঞ্জি ও শব্দকোষ ছাড়া, সেটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। লেখকেরা দেশবিদেশের বিভিন্ন গ্রন্থাগার ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা ‘দশম গ্রন্থ’-এর নানা পুথি বিচার করে কয়েকটি মূল্যবান সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন।
প্রথমত, গবেষকরা পুথির নিবিড় পাঠের পাশাপাশি, তার সূত্র ধরে শিখগুরুর রচনাশৈলীর কোনও বিশেষ লক্ষণ আছে কি না, তা খুঁজতে উদ্যোগী হয়েছেন। তার পরে স্বীকৃত ‘দশম গ্রন্থ’-এর সম্পাদিত সংস্করণের বাইরে থাকা এমন অনেক বহুলপ্রচলিত রচনাকে চিহ্নিত করেছেন, যেগুলি তাঁদের মতে গুরুর রচনা। গবেষকদের মতে, ‘দশম গ্রন্থ’-এর চূড়ান্ত সম্পাদনা (১৬৮০-১৭০৫) দশম গুরুর জীবিতাবস্থায় হয়েছিল। একই সঙ্গে ‘দশম গ্রন্থ’ এর অন্তর্গত বিভিন্ন রচনার (যেমন, ‘বচিত্র নাটক’, ‘চন্ডী দি ভর’, ‘কৃষ্ণাবতার’ ইত্যাদি) পুষ্পিকার পাঠ অনুসরণ করে, সেগুলির প্রত্যেকটি পঞ্জাবের কোথায় বসে এবং কোন সময়ে শিখগুরু রচনা করেছিলেন, তা নির্দেশ করে গবেষণায় মৌলিকতা দেখিয়েছেন। গুরুর মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় শিষ্য ভাই মনি সিংহ ‘দশম গ্রন্থ’ প্রথম সম্পাদনা করেছিলেন বলে যে দীর্ঘ দিনের বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে, তাতে তাঁরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, সমকালীন পঞ্জাবের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার পর, গবেষকরা ‘দশম গ্রন্থ’-এর বিভিন্ন রচনাকে শিখ দর্শনের তাত্ত্বিক নিরিখে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁদের মতে, শিখগুরু নিজের অনুগামীদের অত্যাচারী মুঘল ও পাহাড়ি রাজাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য এক আদর্শ ‘সন্ত-সৈনিক’ হিসেবে গড়ে তোলার কল্পনা করেছিলেন। তারাই পঞ্চ ‘ককারধারী’ ‘খালসা’ নামে নতুন ভাবে জন্ম নিয়ে জাতি, কুল ও মানকে অস্বীকৃতি জানায়। গুরু তাঁদের সত্য ও ন্যায়ের মূল্যবোধে সঞ্জীবিত করবার জন্যে ‘দশম গ্রন্থ’ রচনা করেছিলেন বলে লেখকরা জানিয়েছেন।
তৃতীয়ত, গবেষকদের মতে, শিখধর্মকে বুঝতে গেলে, তাঁদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ‘আদি গ্রন্থ’-কে পাশাপাশি রেখে ‘দশম গ্রন্থ’-কে পড়তে হবে। ‘আদি গ্রন্থ’-এ প্রথম ছয় শিখগুরুর রচনা আছে। কিন্তু ‘দশম গ্রন্থ’-এ কেবল দশম গুরুর কাব্যসৃষ্টি স্থান পেয়েছে। দুটি গ্রন্থের সুর আলাদা হলেও তাদের পাশাপাশি না পড়লে, শিখগুরুদের পরম্পরাভিত্তিক রচনাকে ঠিক মতো অনুভব করা যাবে না বলে তাঁরা মনে করেছেন। সামগ্রিক ভাবে, শিখ গুরুরা ‘আদি গ্রন্থ’-এর ‘শান্ত রস’-এর সঙ্গে ‘দশম গ্রন্থ’ এর বীর রস-এর বেণীবন্ধন করে মধ্যযুগের পঞ্জাবের গ্রাম সমাজের বহু প্রান্তিক মানুষকে স্পর্শ করেছিলেন। তাঁদের বাণী পার্থিব ও অপার্থিব জগতের মেলবন্ধন ঘটাতে সচেষ্ট হয়। তাই শিখেরা ঈশ্বর সৃষ্ট পৃথিবী পরিত্যাগ না করে, তার মাটিকে মধুময় ভেবে ধুলামন্দির গড়তে উৎসাহিত হয়েছিল। প্রাক-আধুনিক পঞ্জাবের প্রতিটি গুরুদ্বারে তাই দুটি ‘গ্রন্থ’-কে পাশাপাশি রেখে সমান শ্রদ্ধায় পড়া হত, যা ‘ঔপনিবেশিক আধুনিকতা’র ফলে পরিত্যক্ত হয়েছে।
দ্য গ্রন্থ অব গুরু গোবিন্দ সিংহ/ এসেজ, লেকচার্স অ্যান্ড ট্রানস্লেশন্স। কমলরূপ সিংহ ও গুরিন্দর সিংহ মান। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৯৯৫.০০
সবশেষে, গবেষকরা ‘দশম গ্রন্থ’-এর বাণীর মধ্যে শিখ সম্প্রদায়ের রাজশক্তি স্থাপনের বীজ লুকিয়ে থাকার ইঙ্গিত পেয়েছেন। তাঁদের মতে, আঠেরো শতকের প্রায় শুরু থেকে, বিশেষ করে ‘দশম গ্রন্থ’-এর চূড়ান্ত সম্পাদনার পর থেকে (১৭০৫), গুরু গোবিন্দের বেশ কিছু বাণী মধ্যযুগের দ্বিপদীর মতো প্রথম থেকেই খালসার মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আঠেরো শতকের রাষ্ট্রশক্তির জন্য লড়াই করবার কালে সেগুলি বৃহত্তর শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে যায় ও জীবনের প্রাত্যহিকতার স্পর্শে তাদের বন্ধন দৃঢ়তর হয়। তাই ‘দশম গ্রন্থ’-কে গবেষকরা খালসার জীবনবেদ নির্মাণের সারগ্রন্থ বলতে কুণ্ঠিত হননি।
অথচ আজ পঞ্জাবের খালসাকে ‘দশম গ্রন্থ’ সম্বন্ধে খোলা মনে আলোচনা করতে কিছুটা যেন দ্বিধাগ্রস্ত দেখি। গত শতাধিক বছর ধরে তাঁদের অনেকে গ্রন্থের কয়েকটি বিশেষ অংশকে হিন্দুগন্ধী, এমনকী অশ্লীল বলে চিহ্নিত করে, তাকে আধুনিক শিখসত্তাবিরোধী বলে ঘোষণা করে থাকেন। বিশ শতকের প্রায় শুরুর দিকে সিংহ সভা আন্দোলনের শেষের দিকে তখনকার তরুণ শিখ নেতারা অকাল তখ্ত থেকে ‘দশম গ্রন্থ’-কে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাঁদের বালকোচিত ‘অহংকার’ প্রকাশ করেছিলেন। প্রায় তখন থেকে পঞ্জাবের বিভিন্ন গুরুদ্বার থেকে
‘দশম গ্রন্থ’-কে বিসর্জনের ঢেউ উঠেছিল, যা আজকাল পঞ্জাবের বাইরে বহু জায়গায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এই ধারার কোথাও কি কোনও ব্যতিক্রম নেই? পঞ্জাব ও তার বাইরে বহু জায়গায় তা আজও আছে, তবে সে ইতিহাস বলার জায়গা ভিন্ন।
‘দশম গ্রন্থ’ গুরুদ্বার থেকে বিসর্জনের প্রধানতম কারণ হল, পঞ্জাবে ইংরেজ শাসন-উদ্ভূত সাম্প্রদায়িক টানাপড়েনে নতুন এবং পৃথক শিখ ও হিন্দু চেতনার সৃষ্টি। নতুন হিন্দু চেতনা ‘শিখ হিন্দু হ্যায়’ বলে দাবি করলে সমকালীন শিখ নেতৃত্ব ‘হম হিন্দু নহি’ বলে ঘোষণা করতে সংকুচিত হয়নি। তার ফলে প্রাক-আধুনিক কালের পঞ্জাবে বহু মিশ্র বিভিন্নতায় গড়া হিন্দু-শিখ পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়তে থাকে। উনিশ শতকের শেষের দিকে তার অন্যতম প্রধান বলি হল ‘দশম গ্রন্থ’, যেখানে গুরু গোবিন্দ বৈচিত্রময় হিন্দু-শিখ চিন্তাচেতনার কথা উচ্চারণ করেছিলেন। বিশ শতকের দীর্ঘ সময় ধরে পঞ্জাবের হিন্দু-শিখ সম্পর্কের অবনতি ঘটায়, স্বাধীনতা-উত্তর কালে ভারতীয় পঞ্জাব ১৯৬৬ সালে আর একবার বিভক্ত হয়। তার পর ১৯৮৪-র ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ ও দিল্লির ‘শিখ নিধন যজ্ঞ’ পঞ্জাবের হিন্দু-শিখ তিক্ত সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেয়। একুশ শতকের গোড়ায় রাজনৈতিক প্রয়োজনে হিন্দু-শিখের তিক্ততা সাময়িক ভাবে কিছুটা পিছু হটে গিয়েছে। কিন্তু তার হাত ধরে কিছুটা ছাই চাপা আগুনের মতো সম্পর্ক বদলের জন্য ‘দশম গ্রন্থ’-এর নতুন পাঠের দরকার আছে। কিন্তু পঞ্জাবের ২০১৭ সালের নবনির্বাচিত আইনসভার হিন্দু-শিখ রাজনৈতিক সদস্যরা কি সেদিকে নজর দেবেন?