চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

নারীর চৈতন্যেও উৎসারিত স্বতন্ত্র আলো

অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত সুজাতা চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।নারী ও পুরুষের শিল্প সৃজনের ভিতর কি কোনও ভেদরেখা আছে, যা দিয়ে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় কোনটা কার? শিল্প তো উঠে আসে শিল্পীর জীবনযাপনের প্রকৃতি থেকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:১১
ছবি: সুজাতা চক্রবর্তী।

ছবি: সুজাতা চক্রবর্তী।

নারী ও পুরুষের শিল্প সৃজনের ভিতর কি কোনও ভেদরেখা আছে, যা দিয়ে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় কোনটা কার? শিল্প তো উঠে আসে শিল্পীর জীবনযাপনের প্রকৃতি থেকে। মানবী ও মানবের প্রকৃতি তো আলাদা। একদিন নারী-পুরুষের সমস্ত সামাজিক বিভেদ নিশ্চয়ই অবলুপ্ত হবে। কিন্তু তখনও প্রকৃতি হয়তো পাল্টাবে না। সৃজনের যে দায় বহন করতে হয় নারীকে, তা তার চৈতন্যেও স্বতন্ত্র আলো উৎসারিত করে। যা পুরুষের থেকে আলাদা। মহাশ্বেতা দেবী-র ‘স্তনদায়িনী’ বা ‘দ্রৌপদী’ কোনও পুরুষের কলম থেকে বেরোত কি না সন্দেহ আছে। সুনয়নী দেবীর ছবি, এমনকী মীরা মুখোপাধ্যায়ের ভাস্কর্য ‘অশোক’-এর শরীর থেকেও যে লাবণ্য উৎসারিত হয়, তার সঙ্গে মানবীচেতনার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে।

এ রকম তো অনেক সময়ই হয় দৈনন্দিন জীবনযাপনের, কাজকর্মের প্রকরণ বা উপাচারগুলোকেই নারী ব্যবহার করেন তাঁর শিল্প সৃষ্টিতে। তা যে শুধু আঙ্গিকেই স্বাতন্ত্র্য আনে, তা নয়; ভাবের ব্যঞ্জনাতেও আনে নতুন আলো। আজকের পোস্টমডার্ন-উত্তর যুগেও অনেক মানবীশিল্পী সুতোর বয়নকে তাঁদের শিল্পের প্রকৃষ্ট মাধ্যম করে নিয়েছেন। তাতে সাম্প্রতিকের সঙ্গে চিরন্তনের একটা প্রকট সেতুও তৈরি হয়েছে।

Advertisement

সে রকমই এক সেতু তৈরির চেষ্টা করেছেন সুজাতা চক্রবর্তী অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তাঁর ষোড়শ একক প্রদর্শনীতে। প্রায় ৩৫টি ছবি নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী। তার অধিকাংশতেই তিনি প্রথাবিরোধী এক প্রকরণ ব্যবহার করেছেন, যা তাঁর দৈনন্দিন গৃহকাজ থেকে উঠে এসেছে। রান্না করার সময় তিনি প্রতিদিন যে মশলা, শস্য বা বীজ ব্যবহার করেন, তাকেই তিনি করে তুলেছেন তাঁর ছবির মাধ্যম। যেমন ডাল, ছোলা, সরষে, কালোজিরা বা মেথির যে দানাগুলো— সেগুলিকে চিত্রপটে সেঁটে অদ্ভুত বুনোট তৈরি করেছেন। বর্ণের বৈচিত্রও এসেছে এই সব শষ্যের রং থেকে। ডিমের খোলার টুকরো টুকরো অংশ ঘনসংবদ্ধ ভাবে ব্যবহার করে চিত্রপটে এনেছেন উচু-নিচু তল বিভাজনের বৈচিত্র। ডিমের খোলার রং অধিকাংশই হয় সাদা, কোনওটি ঈষৎ হলুদও হয়। দু’রকম খোসা পাশাপাশি ব্যবহার করায় বর্ণের ভিন্নতা এসেছে। কোথাও হয়তো তুলি দিয়ে একটু রং ছুইয়েও দিয়েছেন। আলো-অন্ধকারের দ্বৈত তৈরি হয়েছে তা থেকে। সব মিলে উঠে এসেছে এক নিসর্গের আভাস, যে নিসর্গ প্রত্যক্ষ বাস্তব নয়, আবার সম্পূর্ণ বাস্তবাতীতও নয়। মূর্তের ভিতর থেকেই শিল্পী বিমূর্ত বের করে এনেছেন। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে বোঁটা-সহ তিনটি তেজপাতা সাঁটা হয়েছে। তেজপাতার নিজস্ব রঙের উপর শিল্পী হয়তো সামান্য বর্ণের প্রলেপও দিয়েছেন। পশ্চাৎপটে রয়েছে সবুজ, সাদা, কালো ইত্যাদি বিভিন্ন বর্ণের ‘অর্কেস্ট্রেশন’। তার উপর প্রকৃত পাতাগুলির উপস্থিতি বাস্তব ও বাস্তবাতীতের ভিতর এক সংলাপ তৈরি করে।

এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ডিসইনটিগ্রেশন অব নেচার’। সুজাতা ১৯৯৩-তে রবীন্দ্রভারতী থেকে চিত্রকলায় স্নাতক শিক্ষা শেষ করেছেন। এর আগেই ১৯৯১-তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর প্রথম একক। সেই থেকে তিনি বিরতিহীন কাজ করে যাচ্ছেন।

এত দিন তাঁর ছবির প্রধান বিষয় ছিল প্রকৃতি ও মানবী। নানা রকম পশুর ছবিও তিনি এঁকেছেন, যা প্রকৃতিরই অংশ। আঙ্গিক হিসেবে ইম্প্রেশনিজম, পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম প্রাধান্য পেয়েছে। এক্সপ্রেশনিজম ও কিউবিজমের বিশ্লেষণও এসেছে কখনও কখনও।

এ বারে ছবির প্রকৃতি এবং তাঁর নিজের প্রকৃতিকেও ভাঙলেন শিল্পী। এই প্রদর্শনীতেও কয়েকটি ছবি রয়েছে যেখানে তিনি এঁকেছেন রহস্যময়তায় আবৃত মানবীমুখ এবং দৃশ্যমান স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দৃশ্য। সেই দৃশ্যের ক্রমিক ভাঙনের কয়েকটি দৃষ্টান্ত রেখেছেন এই প্রদর্শনীতে। তার পরই এসেছে পরিপূর্ণ বিশ্লেষণাত্মক প্রতিমাকল্প। যেখানে প্রকৃতির স্বাভাবিক দৃশ্যমানতা কিছু নেই। কিন্তু স্পন্দনটুকু রয়ে গেছে। সেই স্পন্দনের ভিতর থেকেছে শিল্পীর আত্মস্বরূপের সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা।

এ ধরনের ছবিতে শিল্পীর ভাবনাটাই প্রধান। স্বাভাবিকতা ও অভিব্যক্তিময়তা থেকে শিল্পী এ বার ভাবনার-ভিত্তিতে পৌঁছেছেন। এই বিবর্তন তাঁর উত্তরণেরই স্মারক। এ বারের ছবিগুলি আকারে ছোট। বড় ক্যানভাসে নিলে ছবি আরও খুলবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement