মার্কোর নিজের শিল্পকর্মও কম ভয়ানক নয়।
ভয় নামক অনুভূতিটি যেমন লম্বা সময় ধরে চলতে পারে, তেমনই আবার তা এক লহমায় প্রবল ভাবে এসে মানুষকে কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যায়। আজ, বুধবার ভূত চতুর্দশী। এই দিনে নাকি ‘তেনারা’ নেমে আসেন ইহজগতে। এই মরসুমেই পশ্চিমী বিশ্বে পালিত হয় হ্যালোইন, অল সোল্স ডে। মেক্সিকোর বাসিন্দারা পালন করেন ‘ডে অব দ্য ডেড’।
হেমন্তের বিষণ্ণ গোধূলিতে যখন আঁধার ঘনিয়ে আসে কবরখানা বা শ্মশানের চারপাশে, তখন অতি বড় সাহসীর বুকেও খানিক দোলা দিয়ে যায় অজানা জগতের বাতাস। তরুণ কানাডিয়ান সাহিত্যিক ও চিত্রকর মার্কো পাঞ্জা মনে করেন, ‘ভয়’ বস্তুটি মুহূর্তেরই ঘটনা। অপ্রাকৃতের একটি ঝলকই পাঁজরের ভিতরে লাবডুব-রত প্রাণপাখিকে চমকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি ২০১৭ সালে লিখে ফেলেছেন ‘ব্রিফ, হরিব্ল মোমেন্টস’ নামের একটি গল্পের বই, যেখানে প্রতিটি গল্পই একটিমাত্র বাক্যে লেখা!
২০২১-এ বিশ্বজোড়া অতিমারি এবং লকডাউনের দমবন্ধ আবহে মার্কো লিখেছেন ‘ব্রিফ, হরিব্ল মোমেন্টস ২’। এই বইয়ে আবার গল্পগুলি দু’টি বাক্যে লিখিত। এই সব ‘ভয়াণু’ রচনার পাশাপাশি বইগুলিতে মার্কো এঁকেছেন গোলমেলে কিছু ছবি। সব মিলিয়ে মার্কোর ভয়ের আসর জমজমাট।
ভয়কে কেন মুহূর্তের বিষয় হিসেবে দেখেছেন, তা মার্কো ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর প্রথম বইয়ের ভূমিকায়। অতি অল্প কথায় তিনি জানিয়েছেন, এক মুহূর্তের কোনও দুঃসংবাদ, কোনও যন্ত্রণা বা কোনও দুর্ঘটনা তীব্র ভয়ের জন্ম দেয়। মুহূর্তের সেই ভয় চারিয়ে যায় পরবর্তী সময়ে। প্রথম বইতে মার্কো তাঁর ‘ভয়াণু’গুলিকে কয়েকটি বিষয়ে ভাগ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে দানব বা উদ্ভট জীব, পরিবার-পরিজন-প্রেম, খাবার, অপরাধ ও শাস্তি, চিকিৎসক ও চিকিৎসা, মানব শরীর এবং একেবারে অজানা উৎস থেকে উঠে আসা ভয়ের মুহূর্ত। এখানে কয়েকটি ‘ভয়াণু’-র সরল বঙ্গানুবাদ দেওয়া হল।
• সে আমার কাঁধে তার হাত রাখল। কিন্তু খেয়াল করলাম তার দেহটা রয়েছে হ্রদের অন্য পাড়ে।
• বাথটবের জল যাওয়ার গর্ত থেকে ভেসে এল আমার ছোটবেলার প্রিয় বন্ধুটির কণ্ঠস্বর— “তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পার।”
• বিশ্বাস করুন, আমার মনে হচ্ছিল, সে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। যদিও তার মুখমণ্ডলে চোখের কোনও চিহ্নই ছিল না।
• মেয়েটি তার পান্নাসবুজ মায়াময় চোখ দিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল আর আমি টের পেলাম আমার পা থেকে কোমর পর্যন্ত পাথরে পরিণত হয়েছে।
উপরের পংক্তিগুলির পিছনে রয়েছে পশ্চিমী জগতের অপ্রাকৃত সাহিত্যচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্য। কোনও গল্পের পিছনে যদি থেকে থাকে গ্যিয়ের্মো দেল তোরো পরিচালিত ‘প্যান’স ল্যাবিরিন্থ’ (২০০৬) ছবির চোখহীন দানব ‘পেল ম্যান’, তো কোনওটিতে রয়েছে গ্রিক কিংবদন্তির দানবী মেডুসার ছায়া, যার দৃষ্টিতে পাথর হয়ে যেত যে কোনও জীবিত প্রাণী।
ভয়ের উৎসকে আবার একেবারেই শূন্য থেকে নামিয়ে আনেন মার্কো। আসলে ‘ভয়’ যে অজানা থেকেই জন্ম নেয়, সেই ধ্রুপদী ধারণাটিকে তাঁর এই সব অতি ক্ষুদ্র গল্পেও তিনি বার বার ফিরিয়ে আনেন। তেমন কিছু উদাহরণও রইল এখানে।
• সেই চওড়া হাসিটা প্রথমে তার এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত বিস্তৃত হল, তার পরে তা ছড়িয়ে গেল এ দেওয়াল থেকে ওই দেওয়ালে।
• লিফ্টের দরজা দু’দিক থেকে আমার শরীরকে চেপে ধরল, কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, ক্রমে পাল্লা দু’টি থেকে বেরিয়ে এল ধারালো দাঁতের সারি।
• আকারে আয়তনে সে বিকট রকমের বড়, তার নীল চোখগুলোর দৃষ্টি আমার ভিতরে তীব্র ভাবে বিঁধতে লাগল, কিন্তু তার অগুনতি হলুদ চোখ ছিল নির্বিকার।
এই তিন গল্পেই কিন্তু কার্যকারণের জায়গাটি আবছা। ভৌতিক কাহিনি বা ভয়ের কাহিনির অন্যতম শর্তই হল আবহ নির্মাণ। সে ক্ষেত্রে লেখক চেনা পরিমণ্ডল থেকে যাত্রা শুরু করেন ও পরে পাঠকের কাছে ক্রমশ অপরিচিত করতে থাকেন পরিমণ্ডলকে। একটি পর্যায়ের পরে গিয়ে কাহিনি তার নিজস্ব যুক্তির পথ ধরে এগোতে থাকে। মার্কো যে হেতু তাঁর কাহিনিগুলি লিখছেন একটি বা দু’টি বাক্যে, সে হেতু সরাসরিই প্রবেশ করতে হয়েছে পরাযুক্তির জগতে। আক্ষরিক অর্থেই এই গল্পগুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে মুহূর্ত-কথন। এমন কাজ করতে গেলে যে বিপুল কল্পনাশক্তির প্রয়োজন পড়ে, মার্কো সে প্রমাণ রেখেছেন সফল ভাবেই।
মার্কোর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ব্রিফ হরিব্ল মোমেন্টস ২’ লেখা হয়েছে ২০২০ সালে, বিশ্বব্যাপী অতিমারি পর্বে। এই গ্রন্থের ভূমিকায় সে কথা জানিয়েছেন মার্কো। ২০২০ তাঁর কাছেও ছিল এক অতিমাত্রিক আতঙ্কের বছর। কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে মাত্রাছাড়া আতঙ্ককে প্রতিহত করতে তিনি কলম ধরেছিলেন আবার কিছু ‘ভয়াণু’ রচনার উদ্দেশ্যে। এ যেন বিষস্য বিষৌষধি। এই বইয়ের দু’টি ভাগ— ‘ন্যাচরাল’ আর ‘সুপারন্যাচরাল’। তবে এই দুইয়ের সীমানা প্রায়শই মুছে যায় তাঁর লিখনে। এখানে রইল তারও কয়েকটি উদাহরণ।
• নোয়া তার নতুন পোশাকটি পরতে গিয়ে দেখল তা তার চামড়ার সঙ্গে লেগে যাচ্ছে, একটু খাটো হচ্ছে যেন মাপে। কিন্তু নোয়া নিশ্চিন্ত, এক মহিলার গা থেকে খুলে নেওয়া এই ছাল কিছু ক্ষণের মধ্যেই তার শরীরের মাপসই হয়ে যাবে।
• রোলার কোস্টারটি যখন তার ট্র্যাকের একেবারে চূড়ায় পৌঁছেছে, তখন ল্যাকলান লক্ষ করল তার পাশের মহিলাটি ক্রমাগত বুকে ক্রস আঁকছেন। মনে মনে হেসে সে তাকাল সামনের দিকে... ট্র্যাকের লাইন ভেঙে রয়েছে সামনেই।
• দোকানের ম্যানেকুইনগুলিকে পোশাক পরাতে গিয়ে হঠাৎই আলোন্সো চমকে উঠল। সে টের পেল একটি ম্যানিকুইন ডুকরে কাঁদতে শুরু করেছে।
• মৃত পশুকে সংরক্ষণের কাজ নোম ভালই জানে। এ কাজ শেখানোর জন্য সে তার বাবাকে ধন্যবাদও দেয়। তার ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত পোষা প্রাণীদের সে অবিকল রেখে দিয়েছে। তাদের দিকে তাকালেই তার মনে পড়ে, সে কী ভাবে তাদের একে একে হত্যা করেছিল।
কোনও সন্দেহ নেই, এই সব কাণ্ডকারখানার মধ্যে যে ভয়ের স্রোত প্রবাহিত, যাকে ‘অপার্থিব’ বলা যায় না। এ সবই মানুষের মনের ভিতরে থম মেরে বসে থাকা অজানা প্রবৃত্তিগুলির বেরিয়ে আসার গল্প। এমন লেখা শুরু হয়েছিল এডগার অ্যালান পো-র হাত ধরে। ‘দ্য পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম’, ‘দ্য টেল টেল হার্ট’ কি আদৌ অপ্রাকৃতের কাহিনি? সেখানে ভয় একেবারেই মানুষের মন থেকে উঠে আসা। কিন্তু এর বাইরেও একটি জগৎ রয়েছে, সেটি অপ্রাকৃতের জগৎ। তেমন কয়েকটি ‘ভয়াণু’-র উল্লেখ করা যেতে পারে।
• যখন তার পুতুল জোলেট তাকে সজোরে জাপটে ধরেছিল, সেই ছোটবেলাতেই আভা টের পেয়েছিল, কী ভয়ানক সেই অভিজ্ঞতা। তার পর জোলেটকে সে সাবধানে পুঁতে রেখেছে, যাতে কখনও কাউকে পুতুলের আলিঙ্গনে না পড়তে হয়।
• চিমনির ভিতর দিয়ে কিছু একটা নেমে আসছে ক্রিসমাসের রাতে। ‘সান্তা ক্লজ’ বলে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল ছোটরা, মরিস তার স্ত্রীকে ফিসফিস করে বলল— “বন্দুকটা দাও তো।”
• তার পেটের ভিতর বেড়ে ওঠা মাংসপিণ্ডটি ক্যানসার কি না, জানার জন্য আলট্রাসাউন্ডের ফলাফল দেখতে চাইল জ্যাকসন। চিকিৎসকরা জানালেন, মাংসপিণ্ডটি মাঝে মাঝেই গর্জন করে উঠছে।
এ ভাবেই চেনা পরিসর এক লহমায় অচেনা করে দিয়েছেন মার্কো। ২০২০ উত্তর পর্বে আবিশ্ব ছেয়ে থাকা অমঙ্গল যেন ছড়িয়ে রয়েছে এই বইয়ের প্রতিটি পাতায়।
দু’টি বই পাঠ করার পরে পাঠক যে রসে নিমজ্জিত হন, তা এক দীর্ঘ অস্বস্তি। পশ্চিমী সাহিত্যের ভয়াল রসের পূর্বসূরিদের কথা মাথায় রেখেই এগিয়েছেন মার্কো। তাঁর সৃষ্ট উদ্ভট দানবরা এইচ পি লাভক্র্যাফটের সৃষ্টিকে মনে করিয়ে দেয়। তাঁর তৈরি করা মানবিক ভয়ের জায়গা মনে করায় পো-কে। কোথাও বা এই দুই জগতের মাঝখানটিতে এক ধোঁয়ার পরিসরে মুখ দেখিয়ে যান স্টিফেন কিং।
কিন্তু সব মিলিয়ে ভয়াল রসের সাহিত্যে একেবারেই অন্য স্বাদ এনেছে মার্কোর এই দু’টি বই। তার কারণ এতে ধরে রাখা কাহিনিগুলির আয়তন। এই ভুতুড়ে মরসুমে অবসর মতো খুলে ফেলে বসা যায় এদের নিয়ে। তবে তার পরে বই থেকে বাঁকা নখওয়ালা রক্তমাখা কোনও হাত এসে যদি তাদের পাতা উল্টে দেয়, তখন কিন্তু কিছু করার থাকবে না!
ছবি ইনস্টাগ্রামের সৌজন্যে