একটি সদ্য-প্রকাশিত বইকে ‘যুগান্তকারী’ বলে অভিহিত করা হঠকারিতা হতে পারে। বিশেষত তার বিষয়বস্তু যদি হয় বহু-আলোচিত পৃথিবী নামে আমাদের বাসগ্রহে মানব-সভ্যতার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, যা অনিবার্য ও অপরিমেয়। তবুও প্রায় এক দশক ধরে গ্রন্থিত বইটিতে দর্শন, ইতিহাস ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান— এই তিন ধারার চিন্তা এবং দৃষ্টিভঙ্গির সামঞ্জস্য ও বৈপরীত্য নিয়ে একটি কালোত্তীর্ণ কাজ করেছেন দীপেশ চক্রবর্তী। লেখকের চিন্তার বিবর্তন যাঁরা দেখে আসছেন, তাঁরা বুঝবেন, দীপেশের বহু দশকের শ্রম ও ভাবনা এখন একটি ব্যক্তিগত পূর্ণতায় পৌঁছেছে। এ বই তারই সাক্ষী।
মনোযোগী পাঠক বইয়ের শিরোনামের মধ্যেই দেখবেন গতানুগতিক চিন্তার বাইরে থেকে দেখা একটি বিতর্ক ও দ্বান্দ্বিকতার বীজ। শিরোনামের আক্ষরিক অনুবাদ: ‘ইতিহাসের জলবায়ু, এক গ্রহজাগতিক যুগে’। জলবায়ু পরিবর্তনের ইতিহাসের জায়গায় বিষয়টিকে ইতিহাসের জলবায়ু বলে গোড়াতেই জানিয়ে দেওয়া হল যে, এই গ্রহে জীবনের অস্তিত্বের সঙ্কট— যার পিছনে মানবসভ্যতার ভূমিকা বহুশ্রুত, বহু-আলোচিত ও বহুবিতর্কিত, সেই বিতর্কে একটি নতুন ঐতিহাসিক পথ খুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এই পথে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে লেখা ও বিতর্ক প্রচুর। তার মধ্যে মানবিক চিন্তার— চিন্তার দার্শনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সর্বোপরি নৈতিক আলোচনা প্রয়োজন। শুধু মানুষই নয়, প্রাণের ও প্রাণিজগতেরও, এমনকি ভাষা এবং আরও অপ্রত্যাশিত ভাবে দু’টি চলতি শব্দের নতুন সংজ্ঞায়নও আবশ্যিক। শেষ পর্যন্ত সব দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রয়োজন, তবু সব মিলিয়ে এক কল্যাণকর সমন্বয়ে না পৌঁছলে এবং সেই সমন্বয়লব্ধ কার্যভারকে চিহ্নিত না করতে পারলে এই ‘মারের সাগর পাড়ি’ দেওয়া অত্যন্তই কঠিন।
লেখক ইংরেজিতে ‘গ্লোবাল’ ও ‘প্ল্যানেটারি’, আমার অনুবাদে বিশ্বজগৎ ও গ্রহজগৎ, এই দু’টি শব্দকে পৃথক করে নিয়েছেন। তাদের পরস্পর-নির্ভর পার্থক্যের মধ্যেই এই কঠিন বিষয়ের বোধগম্যতা এবং সমাধানের পথ পাওয়া আবশ্যিক মনে করাচ্ছেন। আলোচনার খাতিরে ধরে নিই যে বিশ্ব এক মানবিক বিশ্ব— মানুষের সব প্রচেষ্টা, সর্বকর্মের লীলাভূমি সেখানে বিশ্বজগতের অধিষ্ঠান, সেখানেই বিশ্বায়ন ঘটে, বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিত হয়, এমনকি সেখানেই বিশ্বজোড়া ফাঁদও পাতা থাকে। সেই বিশ্বের সঙ্গে লেখক দেখছেন সেই বিশ্বের প্রাকৃতিক আধার, অর্থাৎ পৃথিবী নামের এক নীল গ্রহের জগৎ, যেখানে সবই একার্থে বাস্তব, জল, স্থল, বায়ু, অগ্নি, মহাশূন্য, জীব ও অনুজীব— তাকে সূর্যকেন্দ্রিক এক ভিন্ন অথচ সংলগ্ন জগৎ হিসাবে। জলবায়ু প্রধানত এই দ্বিতীয় জগতের বিষয়। অনেক চিন্তাধারায় তার প্রধান উপকারিতা ওই প্রথম বিশ্বে মানবসভ্যতার বিকাশের আধার ও সহায়ক রূপে। বিশ্বজগৎ এই গ্রহজগৎকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া জরুরি মনে করেনি। মানুষ নিজের গৃহের কল্যাণের জন্য যতটা সচেতন, মনুষ্যসমাজ, ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে, নিজের গ্রহের কল্যাণের জন্য তার একাংশও চিন্তিত নয়। গ্রহজগৎকে মহাজগতের মতোই অনাদি, অনন্ত, অপরিবর্তনীয় ভাবা হয়েছে। মানুষের কাজে লাগার জন্যে যতটুকু প্রয়োজন, তার বাইরে গ্রহের কল্যাণের দায়িত্বভার গ্রহণের কথা ভাবা হয়নি। উল্টে ভাবা হয়েছে মানবসভ্যতার প্রধান উদ্দেশ্য জড় ও মনুষ্যেতর প্রাণিজগতের উপর আধিপত্য বিস্তার— অর্থাৎ, প্রকৃতিকে বশে আনা। কয়েক শতাব্দী ধরে সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তারের মূলমন্ত্র পৃথিবীতে অগ্রগণ্য জাতি, রাষ্ট্র, সভ্যতারা বিনাবাক্যে গ্রহণ করেছিল। আধুনিকতার সঙ্গে ঔপনিবেশিকতা, ধনতান্ত্রিকতা স্বাভাবিক ভাবেই এক সূত্রে গ্রথিত। শিল্পবিপ্লবে এদের সমাবেশ সবচেয়ে পরিষ্কার দেখা যায়।
এই বইতে প্রগতির সঙ্গে অসাম্যের সংযোগকে বিশেষ মূল্য দেওয়া হয়েছে বলেই জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে রোহিত ভেমুলার মর্মান্তিক ঘটনা স্থান পেয়েছে। এই অংশটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী এবং অন্তর্দৃষ্টিতে আলোকিত। রোহিত যখন নিজেকে এক দলিত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত না ভেবে কার্ল সেগানের ‘তারা থেকে ঝরা’ ভাবতে ভালবাসেন (যা অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় ‘সৌরধুলো তৈরী দেহ’-কে মনে করায়), তখন গ্রহকে শোষণ ও শাসনের সঙ্গে অন্য জাতিকে, অন্য দেশকে, অন্য বর্ণকে, সমাজের অন্য সম্প্রদায়কে শাসনের উদগ্র কামনা অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে যায়। সামনে তাকালে শুভ্র সকালের হাতছানি। আর পিছনে তাকালে রক্তের পদচিহ্ন!
কয়েকটি প্রস্তাবনা যেন এরই মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটাই হল— অবশ্যই বিশ্বজগৎ ও গ্রহজগৎকে পৃথক করা এবং সেই পার্থক্যের মধ্যে দার্শনিক চিন্তায় আজকের মহাসঙ্কটের বীজকে খুঁজে পাওয়া। দ্বিতীয়, এই বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, মানবিক চিন্তাকে বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতা ও তথ্য-নির্ভর সাক্ষ্যের সঙ্গে একাসনে স্থান দিতে হবে, শুধু বিজ্ঞানের স্বকীয় পদ্ধতির উপর ভরসা রাখা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেবে।
তৃতীয়, এই অভিনব প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে গবেষণা, ভিন্ন মতের আলোচনা ও সৎ বিতর্কের জায়গায় লেখক এতটুকু কার্পণ্য করেননি। তাঁর ইতিহাসচর্চা যে দর্শনের প্রতি উত্তরোত্তর আকৃষ্ট হচ্ছে, সেটাও স্পষ্ট। এই প্রসঙ্গে দীপেশ চক্রবর্তী ও ব্রুনো লাটুরের দীর্ঘ কথোপকথনটি পাঠকের কাছে এক অপ্রত্যাশিত পুরস্কার। সহমর্মী দুই পণ্ডিত, অথচ সর্বাংশে সহমত নন, বরং পরস্পরের পরিপূরক। এর থেকে সুতর্কের শিক্ষা মেলে।
বইটিতে চিন্তার ব্যাপ্তি বিশাল। এই সমালোচকের বিদ্যার বিস্তার শুধু প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ। তাই বইটিতে আধুনিক বিজ্ঞানের চিন্তা থেকে উদাহরণ দেওয়ার লোভ সংবরণ করা কঠিন। একটি হল ‘সময়’ (টাইম)। সময়ের অনেক মাত্রা, মহাজাগতিক থেকে পারমাণবিক বা আরও ছোট। যখন মাত্রা দু’টি অনেক পৃথক, তখন বড়টিকে ছোটটির দৃষ্টিতে স্থাণু বা অচল ধরে নিলে ক্ষতি নেই। যেমন, গ্রহজগতের সময়কাল এক মানবপ্রজন্মের সময়কালের চেয়ে এতই বড় যে, আগামী কাল সকালের সূর্যোদয় নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই।
অন্যটি হল ‘স্থান’ (স্পেস), ত্রিমাত্রিক ভুবনে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা নিয়ে একটি ‘আয়তন’ পাই। যখন দু’টি বস্তুর আয়তনের পার্থক্য বিরাট, তখন একটিকে অসীম ভাবলে ক্ষতি নেই। সমস্যা সেখানেই, যখন দু’টি বস্তুর আয়তন কাছাকাছি, দু’টি প্রক্রিয়াই সমকালীন, পরস্পরনির্ভর ও সমানুবর্তী। আমাদের সাধারণ বুদ্ধি যে সরলরেখায় চলে, এই ঘটনাগুলি তার মাপে চলে না। তখন তাকে আমাদের অনভিজ্ঞতার নিরিখে জটিল বলি।
আমাদের বর্তমান যুগসন্ধি এমনই এক জটিল সমস্যার মুখোমুখি। মানবসভ্যতার কাজ, বিশেষত প্রযুক্তির আয়তন গ্রহের আয়তনের সঙ্গে তুলনীয়। মানুষের কাজের সময়কাল এখন জলবায়ুর পরিবর্তনের সময়কালের সঙ্গে তুলনীয়। আধুনিকতার ইতিহাসে এই রকম জটিলতার উদাহরণ লিপিবদ্ধ নেই। এর মোকাবিলায় আমরা অনভিজ্ঞ।
এ প্রসঙ্গে লেখকের মত স্পষ্ট। সরলরেখার ইতিহাসকে অন্যান্য বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক চিন্তায় স্থান করে দিতে হবে। অবশ্যম্ভাবী ভাবে ইতিহাসের জলবায়ু বদলাবে। পরিবর্তিত নতুন ইতিহাসকে প্রাকৃতিক দর্শনের আঙিনায় এক গুরুত্বপূর্ণ আসন দিতে হবে।
ইতিহাসবিদের ভূমিকা তবে কী? ইতিহাসের স্রষ্টা না ইতিহাসের দাস ও ঘটনার লিপিকার? দীপেশের লেখায় ইতিহাসের সংজ্ঞা ও স্বভাব নিয়ে চিন্তার বিবর্তন হয়ে চলেছে। পাঠক চাইবেন, সেই স্রোত বইতে থাকুক।
শেষে একটি সতর্কবাণী। বইটিতে বিষয়ের প্রসার চক্রবৎ, শেষাংশের পর প্রথমাংশে আরও মণিমাণিক্য মেলে। দ্বিতীয়ত, বাংলার মতোই ইংরেজিতেও লেখকের ভাষার সাবলীলতা অর্ধমনোযোগী পাঠককে ভুল বোঝায়। ভারী কথা নির্ভার ভাবে প্রকাশিত হয়, কিন্তু তার ওজন কমে না। সে-জন্যে পুনঃপাঠে অপ্রত্যাশিত পুরস্কার মেলে।
জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বায়ন, উষ্ণায়ন, পরিবেশ দূষণ— এই সব সংলগ্ন সঙ্কটচিন্তার একটা নতুন ঐতিহাসিক মোড় ফিরল মনে হয়। সেই পথে নতুন চিন্তাবিদ গবেষক নিঃসন্দেহে আসবেন। এই বই তাঁদের যাত্রার পথে পথিকৃৎ হয়ে থাকবে।
“আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশীদার/ অপরে পাওনা আদায় ক’রেছে আগে/ আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।/ তাই অসহ্য লাগে ও আত্মরতি/ অন্ধ হ’লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে/ আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি/ ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।” ‘উটপাখী’, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।