book review

Book review: আলো ফেললেন ভাষার ধাঁধায়

আমেরিকায় গবেষণা করে ক্রিয়োলতত্ত্বের গভীরে ঢুকতে চাইলেন পেগি। প্রাচীন নবীন সাহেবি ভারতীয় অনেকগুলো ভাষা শিখলেন প্রখ্যাত গুরুদের সাহচর্যে।

Advertisement
প্রবাল দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২১ ০৮:০১

ওয়ান্ডারার্স, কিংস, মার্চেন্টস: দ্য স্টোরি অব ইন্ডিয়া থ্রু ইটস ল্যাঙ্গোয়েজেস
পেগি মোহন
৫৯৯.০০
পেঙ্গুয়িন ভাইকিং

ত্রিনিদাদে বড় হতে হতে পেগি মোহন লক্ষ করেছিলেন, ইংরেজিভিত্তিক যে ত্রিনিদাদি ‘ক্রিয়োল’ (বা ‘খিচুড়ি-ভাষা’) তাঁর মাতৃভাষা, সেটাকে সত্যিকারের ইংরেজির ভাঙা-ভাঙা অপভ্রংশ বলে মনে করে সবাই। ও দিকে পেগি আবছা টের পাচ্ছিলেন, পিতৃকুলের ভাষা ভোজপুরির সঙ্গে হিন্দিরও অনুরূপ সমীকরণ রয়েছে সুদূর ভারতে। সেখানেও ওজনদার ভাষা হিন্দির তুলনায় ভোজপুরিকে খানিকটা ভাঙাচোরা দেখায়। তবে ভোজপুরিকে হিন্দির অপভ্রংশ ভাবে না কেউ। ভাষার মানচিত্রটা যে সর্বত্রই এবড়োখেবড়ো, এ কথা বিলক্ষণ জানা হয়ে গিয়েছিল পেগির। কানাডিয়ান মা আর ত্রিনিদাদি বাবার কাছে ত্রিনিদাদে মানুষ হলে এ বিষয়ে সচেতন হওয়াই স্বাভাবিক। নিজের খিচুড়ি/ ভাঙাচোরা/ গৌণ মাতৃভাষার পাশাপাশি পোশাকি ইংরেজিটুকু শিখলেই ওই বন্দি দশার খাঁচা থেকে বেরোনো যায় না কি। আবাল্য জমে ওঠা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দ্বীপপুঞ্জের বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হতে হয়। তাতেও মন ওঠে না।

Advertisement

আমেরিকায় গবেষণা করে ক্রিয়োলতত্ত্বের গভীরে ঢুকতে চাইলেন পেগি। প্রাচীন নবীন সাহেবি ভারতীয় অনেকগুলো ভাষা শিখলেন প্রখ্যাত গুরুদের সাহচর্যে। ক্রমশ জানতে পারলেন, রোমহর্ষক একাধিক রহস্য উপন্যাসের সমস্ত সুতোর জট পাকিয়ে গিয়েছে। তাত্ত্বিকেরাও হিমশিম খাচ্ছেন। নানা জায়গার ক্রিয়োল স্পষ্টতই নানা ভাবে রান্না করা হয়েছে। অথচ, রীতিমতো দলিলে লিপিবদ্ধ ভারিক্কি ভাষাদের ইতিহাস ছকে ফেলা সোজা বলে সে দিকেই গবেষকেরা মন দিয়েছেন। মিশ্র ভাষাদের কাহিনিটা খুলে বলার উপকরণ জোগাড়ই বা কী করে হবে, এক-একটা অনুমানের প্রমাণই বা কোথা থেকে জুটবে, এ প্রশ্নগুলো ঝুলে রয়েছে।

গবেষণার শেষে দীনেশ মোহনকে বিয়ে করে পেগি পাড়ি দিলেন এই ভারতেই। আযৌবন ভারতে বাস করে প্যাঁচালো রহস্যকাহিনির জট ছাড়াতে লাগলেন। আশা করছিলেন, পারিবারিক ধাঁধার উত্তর পেয়ে যাবেন, ভারতীয় ভাষার ইতিহাসের গোলমেলে জায়গাতে খানিক আলোকপাত করতে পারবেন। আশা থাকে অনেকেরই। কিন্তু পেগি মোহন সত্যিই অসাধ্যসাধন করেছেন। বহু বছর মেহনত করে যে প্রাঞ্জল বই লিখেছেন, তাতে পুরো গল্পটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।

অবহিত পাঠক বলবেন, সে আবার কী? কীই বা অস্পষ্ট ছিল সুপরিচিত গল্পে? সবাই শুনেছি, আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত সংস্কৃতই উত্তর ভারতের প্রধান প্রধান আধুনিক ভাষা (অর্থাৎ বাংলা, মরাঠি প্রভৃতির) উৎস। ওয়াকিবহাল পাঠক এ-ও শুনেছেন যে, বৈয়াকরণদের বেঁধে দেওয়া যে চেহারাটা ‘সংস্কৃত’ অর্থাৎ পরিশীলিত বলে গণ্য, সেই পারিপাট্যের আড়ালে বৈদিক অবৈদিক নানাবিধ রকমফেরের সমারোহ ছিল। ভাষাতাত্ত্বিকেরা তাকে বলেন ‘প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষাগুচ্ছ’। সেই বিচিত্র ভাষাসমূহেরই এক-একটা ধারা থেকে প্রবাহিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষার বিবর্তনের স্রোত। পরবর্তী যুগে শৌরসেনী, মাগধী, প্রাকৃতের মতো আরও পাঁচটা মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষা হয়ে, সেই স্রোত অপভ্রংশের ঘাট পেরিয়ে গত এক হাজার বছরে এসে পৌঁছেছে নব্য ভারতীয়-আর্য পর্যায়ের বাংলা, ওড়িয়া, মরাঠি, সিন্ধি প্রভৃতিতে। ভাষার এ সমস্ত পরিবর্তনের পাই-পয়সার হিসাব পণ্ডিতেরা কড়ায়-গন্ডায় কষে নিয়েছেন বলেই সবাই জানি। হঠাৎ পেগি মোহনের বই লিখে ফাঁক ভরার কেনই বা দরকার হল? ফাঁক-ফোকর ছিল বুঝি সর্বজনবিদিত কাহিনিতে?

পাই-পয়সার হিসাবটা খতিয়ে দেখলে বেশ কিছু ফাঁক-ফোকর যে চোখে পড়ে, সে কথা বিবর্তনমূলক ভাষাতত্ত্বের কর্মীরা অনেক দিন ধরেই জানেন। সেই সংশয়ের ধাক্কায় আনকোরা নতুন ভাষ্যের প্রস্তাবও করেছেন কেউ কেউ। “ভারতীয়-আর্য পরিবারের ভাষা হয়েও বাংলা ভাষা মুন্ডা-পরিবার-ভুক্ত সাঁওতালির মতো উৎস থেকে প্রচুর শব্দ ধার নিয়েছে”, এই বক্তব্যটাকে উল্টে দিয়ে তাঁরা দাবি করেছেন, “বাংলা আসলে মুন্ডা পরিবারেরই ভাষা, কিন্তু অগুনতি শব্দ ধার নিয়েছে সংস্কৃত-প্রাকৃত থেকে।” প্রচলিত বিশ্বাসের যে স্থাপত্য থাকে, সেটাকে স্রেফ উল্টে দিয়ে যে সমস্যা মেটানো যায় না, এটা অনেকেই ঠেকে শিখেছি। সাবেক কালের বিবর্তনমূলক ভাষাতত্ত্বের সামগ্রিক হিসাবনবিশির কায়দা-কানুন আস্ত রেখে বাংলা বা মরাঠির পারিবারিক পরিচিতি পাল্টানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। বিশুদ্ধ বংশানুক্রমিক পরিচিতির গল্পটারই যে গোড়ায় গলদ।

সামগ্রিক ভাবে ওই ‘বিশুদ্ধতা’ ব্যাপারটা নিয়ে যে সঙ্কট আমাদের সমস্ত ভাবনাকে গ্রাস করেছে, তার কথা উত্থাপন করার লোভ সামলে বিশেষ করে বলা দরকার ‌যে, বিশুদ্ধ বংশপরিচিতির ধারণাটা ভাষাতত্ত্বের ধোপে টেকে না। “বাংলা কি মুন্ডা পরিবারের সন্তান, না ভারতীয়-আর্য পরিবারের?”— এ প্রশ্নটাই গোলমেলে; এই শব্দচয়নে প্রস্তাবিত দুটো জবাবই বিভ্রান্তিকর। ‘দু’দিকের মিশ্রণ’ তো বটেই, কিন্তু ঠিক কী ভাবে সেই মিশ্রণ ঘটেছে, এবং মিশ্র ভাষাকে অনুধাবন করার কী ধরনের সূত্র কোথায় কোথায় প্রযোজ্য, এই প্রশ্নগুলো নিয়ে প্রত্যেক এলাকায় আলাদা করে আলো ফেলেছেন পেগি।

তর্কসাপেক্ষ বিষয়ে রচিত আস্ত বইয়ের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় সেই আলোকপাতের চুম্বক দেওয়া যাবে না। ইচ্ছা করেই অতি-সরলীকৃত ছবি দিচ্ছি এখানে, পূর্ব ভারতের বেলায়। এই মোটা দাগের রেখাচিত্রের সঙ্গে পেগির সূক্ষ্ম হাতে আঁকা তৈলচিত্রের সাদৃশ্য অল্পই, কিন্তু আমি নিরুপায়।

‘আদিবাসী’ বলে পরিগণিত মুন্ডাদি (মুন্ডা, দ্রাবিড়, ভোট) ভাষা-পরিবারের সন্তানপদবাচ্য অনেকগুলো ভাষায় কথা বলত পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী। বাইরে থেকে ‘আর্য’ভাষী কিছু প্রতাপশালী পুরুষ সেই এলাকায় এসে জাঁকিয়ে বসল। সঙ্গে স্বজাতীয় তথা স্বভাষী মহিলা আনেনি। অতএব, স্থানীয় মেয়েদের সঙ্গেই ঘর বাঁধল। সেই মেয়েরা মুন্ডাদি ‘আদিবাসী’ ভাষার উচ্চারণের অভ্যাসমাফিক বাঁকা উচ্চারণ সহযোগে স্বামীদের ‘আর্য’ ভাষা নিজেরা তো রপ্ত করলই, তাদের বাচ্চারাও মায়েদের কাছ থেকে ওই বাঁকা উচ্চারণের রসে জারিত আকারেই শিখল বাবার ভাষা। এই প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসছে একাধিক ‘পূর্ব ভারতীয়-আর্য’ (বা ‘মাগধী’) ভাষা। তাদের গায়ে দু’দিকের যে ছাপ রয়েছে, তা নিয়ে একটু কথা বাড়ানো দরকার।

ভোজপুরি, বাংলা, অসমিয়া প্রভৃতি ভাষার আকৃতিতে স্রেফ মাতৃকুলের মুন্ডাদি ভাষার উচ্চারণটুকুই আছে, বাকি মালপত্র সব পিতৃকুলের আর্য ভাষা থেকে পাওয়া, এ কল্পনা ভুল। ‘মালপত্র’-এর মতো প্রতিবিম্ববাহী সমাসগঠন; ‘ঘ্যানঘ্যান’ বা ‘চটপট’-এর মতো ধ্বন্যাত্মক ইশারাবিদ্ধ শব্দভঙ্গি; সংখ্যার সঙ্গে বিশেষ্য জোড়ার সময় মধ্যস্থের ভূমিকায় অবতীর্ণ ‘বর্গিক’ উপাদান— এক-‘গাছা’ লাঠি, পাঁচ-‘টা’ আম, ছ-‘খানা’ লুচি ইত্যাদি। মুন্ডাদি-গোত্রীয় ভাষাগুলোর অভ্যাসবশত উচ্চারণরীতির সঙ্গে সঙ্গে শব্দের গার্হস্থের এই সমস্ত সরঞ্জামও চলে এসেছে পূর্ব ভারতীয়-আর্য ভাষার উপকরণ-বিন্যাসে।

বহু শতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে ঘটেছে এই মিশ্রণ। বাবাদের ভাষার পাশ দিয়ে বাচ্চারা মায়েদের মুন্ডাদি পরিবারভুক্ত গৌণ ভাষাও শিখতে থাকে। এমনকি, আজকের পূর্ব ভারতেও সাঁওতালি, মুন্ডারি, হো প্রমুখ মুন্ডাগোত্রীয় ভাষা বেঁচে আছে; আছে মালটো আর কুড়ুখ-এর মতো দ্রাবিড়গোত্রীয় ভাষা, বোড়ো বা কগবরকের মতো ভোটগোত্রীয় ভাষা। প্রতিবেশী ভাষা-সমবায়দের মধ্যে লেনদেন চলতেই থাকে।

পেগি একাই পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি আঁকেননি। প্রাচীন ভারতে জনগোষ্ঠীর মিশ্রণের ইতিবৃত্তের চেহারা সাম্প্রতিক জেনেটিক্স-আশ্রয়ী প্রত্নতত্ত্বে পরিস্ফুট হয়েছে— তার সুখপাঠ্য অথচ নিশ্ছিদ্র বিশ্লেষণ দাখিল করেছেন পেগির সহপথিক টোনি জোসেফ, আর্লি ইন্ডিয়ানস: দ্য স্টোরি অব আওয়ার অ্যানসেস্টার্স অ্যান্ড হোয়্যার উই কেম ফ্রম বইয়ে। পেগির আর টোনির বইয়ের সারসংক্ষেপ-স্বরূপ সাক্ষাৎকারের ভিডিয়ো পাবেন ইন্টারনেটে। কিন্তু বই দুটো পড়ে দেখুন না!

আরও পড়ুন
Advertisement