Book Review

বাউলের নিজস্ব অনুভবের স্বাক্ষর

বাউলতত্ত্ব ও সাধনা নিয়ে বহু গ্রন্থ, লেখালিখি, আলোচনা রয়েছে। সঙ্কেতপ্রবণতা এই সাধনার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নিজেদের সাধনতত্ত্ব, সাঙ্কেতিক সঙ্গীতের মাধ্যমে মন্ত্রের মতো যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করে গেছেন বাউল সাধকেরা।

Advertisement
উপালী চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৪ ০৭:১১
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

বাউল সাধকগুরু সনাতন বাউল দাস ঠাকুরের লেখা বইটি, তাঁর শিষ্যা পার্বতী বাউলের সম্পাদনায় প্রকাশিত। এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের সম্পাদক ছিলেন ঋতবান ঘটক। সেই সংস্করণে প্রকাশিত লেখার সঙ্গে নতুন পর্ব, আরও অনেক ছবি ও গান যোগ হয়েছে নতুন এই সংস্করণে। প্রথম সংস্করণটির ৭০টির অধিক গান ও সেই নিয়ে প্রশ্নোত্তরধর্মী আলোচনা নতুন বইটিতে ‘বাউল প্রেমিক: সূত্রপাত’ পর্ব হিসাবে প্রকাশিত। গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বের নাম ‘বাউল প্রেমিক: অন্তিমচরণ’, যেখানে আরও ৪৩টি গান-সহ গূঢ় তত্ত্বালোচনা রয়েছে বাউল বিষয়ে, যা এত দিন অপ্রকাশিত ছিল। তৃতীয় পর্বে রয়েছে জাপানের গবেষক মাসাইউকি ওনিশি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্গা দত্তের সঙ্গে সনাতন দাস বাউলের প্রশ্নোত্তর-ভিত্তিক আলোচনা। রয়েছে সব ক’টি সংস্করণের প্রচ্ছদ-সহ সংক্ষিপ্ত রূপরেখার বিবরণ, পরিশিষ্ট অংশে সনাতন বাবার গুরুক্রম, জীবনপঞ্জি, বংশলতিকা, উল্লিখিত সাধুগুরুদের ও মেলার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, গানের বর্ণানুক্রমিক সূচি, তথ্যসূত্র-নির্দেশ এবং বেশ কিছু চমৎকার আলোকচিত্র।

Advertisement

বাউলতত্ত্ব ও সাধনা নিয়ে বহু গ্রন্থ, লেখালিখি, আলোচনা রয়েছে। সঙ্কেতপ্রবণতা এই সাধনার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নিজেদের সাধনতত্ত্ব, সাঙ্কেতিক সঙ্গীতের মাধ্যমে মন্ত্রের মতো যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করে গেছেন বাউল সাধকেরা। সেই চর্যাপদের চারণকবি থেকে কবি জয়দেব, নিত্যানন্দ হয়ে লালন ও তাঁর সমসাময়িক এবং বর্তমানের সাধক পর্যন্ত বাউলের মন্ত্র তাঁদের সঙ্গীত, যা সম্পূর্ণ সঙ্কেতে বাঁধা। ভারতের সাধনমার্গই আসলে সাঙ্কেতিক। যোগ্য সাধকের জন্য সেটি তুলে রাখা থাকে সাধনার গোপন কুলুঙ্গিতে। গত দেড়শো বছরে বাউল গবেষকেরা যেটুকু জেনেছেন বুঝেছেন বাউল-সঙ্গ করে, বাউল বিষয়ে এত দিন আমরা মূলত সেই লেখাগুলিই গ্রন্থাকারে পেয়েছি। কিন্তু, কোনও বাউল সাধক নিজে, নিজেদের সাধনকথা এই প্রথম প্রকাশ করলেন। আধুনিক শিক্ষিত সমাজের কাছে সনাতন বাবাই প্রথম তুলে ধরলেন বাউল সাধনার অন্ধিসন্ধি। এক জন বাউল ও এক জন জিজ্ঞাসু বাউল প্রেমিকের নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন গুরু সনাতন বাউল, নানা গান ও মন্ত্রের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা করছেন, প্রেমিক ও পাঠককে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ এক গভীর নির্জন পথে, যেখানে জীবন-জিজ্ঞাসা এক নিশ্চিত উত্তর পাচ্ছে।

বাউল প্রেমিক

সনাতন বাউল দাস ঠাকুর

৭৫০.০০

একতারা কালারি

সনাতন বাবার যোগ্য শিষ্যা পার্বতী বাউল বইটি সম্পাদনা করেছেন। ‘অন্তিমচরণ’ পর্বটি, নতুন শুধু নয়, যেন আরও অন্তরঙ্গ। সাধনমার্গের নানা গূঢ় তত্ত্ব সহজ সরল ভাবে নাটকের আঙ্গিকে পরিবেশন করেছেন সনাতন বাবা। সহজ কথ্য ভাষা এবং গভীর তত্ত্ব আলোচনা, এই দুই ধারায় বাঁধা এই বই এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। কী ভাবে, কোন পথে পাঠককে হঠাৎ হঠাৎ এনে ফেলছেন বাউলের প্রাণভ্রমরার ভিতর, দেখিয়ে দিচ্ছেন দেহের ভিতরের গোপন বাগান-ঝর্না-পাহাড়-নদী-জঙ্গল, এ যেন এক বিচিত্র লীলাখেলা।

এই বই বাউলের নিজস্ব অনুভবের স্বাক্ষর, বাউল সাধক সনাতন দাস ঠাকুর বাউলের সাধনসূত্রগ্রন্থ। সে সাধনসূত্র রয়ে গেল ভাবীকালের জন্য। শেষে বলছেন, “তোমাদের সকলের জীবন মনের মানুষের প্রতি আরাধনা হয়ে উঠুক, প্রত্যেকটি দিন এক-একটি প্রার্থনা গান হয়ে উঠুক। গুরুকৃপা লাভ হোক, সবার মঙ্গল হোক, সবার চৈতন্য হোক।” বাঁধাই ও প্রচ্ছদ সুন্দর, বইটি সুপরিকল্পিত। পার্বতী বাউল-সুরমিতা রায়ের যুগ্ম সম্পাদনা এবং ‘একতারা কালারি’র প্রকাশনায় বইটি ভারতীয় ও বাউল সাধনমার্গের এক দিশারি গ্রন্থ হিসাবে রয়ে যাবে।

নজরে

বাবরি মসজিদ যখন ধ্বংস করা হল, জ়েয়াদ মসরুর খানের বয়স তখন পাঁচও হয়নি। আলিগড়ের ছেলে। স্কুল শেষ করে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, তার পরে বাইশ বছরের তরুণ দিল্লিবাসী হলেন জামিয়া মিলিয়ায় সাংবাদিকতার পাঠ নিতে। আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় নানা সংবাদ সংস্থা ও পত্রিকায় সাংবাদিকতা করে ২০২০-র গোড়ায় দিল্লি ছেড়ে আলিগড়ে ফিরে স্বাধীন জীবন যাপনের নতুন পর্ব। গত বছরে প্রকাশিত বইটি তার ফসল।

আলিগড়ে যে বাড়িতে অনেক কালের পারিবারিক বসতি, তার অবস্থান পাড়ার শেষ প্রান্তে— তার পরেই হিন্দু এলাকা। সেই সীমান্তে জ্ঞান হওয়ার মুহূর্ত থেকে শুরু করে গত তিন দশকে বড় হয়ে ওঠার পথে স্বচ্ছ নিরাবেগ দৃষ্টিতে তরুণ লেখক লক্ষ করেছেন, সংখ্যাগুরুর আধিপত্য কী ভাবে সংখ্যালঘুর দৈনন্দিন অস্তিত্বকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলল। নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ার অগাধ শূন্যতা উপলব্ধি করেছেন একেবারে দানবের পেটের ভিতরে বসে। আর তাই, চলতি বাগ্‌ধারায় যাকে পবিত্র শৈশব-টৈশব বলা হয়, সেই বয়সের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়ে দেন, তাঁদের কাছে সাম্প্রদায়িক অশান্তির উদ্বেগ কোনও বিশেষ সময়ের ব্যাপার ছিল না, ছিল “আমাদের অস্তিত্বের একটি অঙ্গ, যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল আমার চার পাশে প্রত্যেকের জীবন।”

সিটি অন ফায়ার: আ বয়হুড ইন আলিগড়

জ়েয়াদ মসরুর খান

৫৯৯.০০

হার্পার কলিন্স

জ়েয়াদ নৈরাশ্যবাদের কবলে আত্মসমর্পণ করেননি, ধর্মীয় পরিমণ্ডলে ও সাম্প্রদায়িক গণ্ডির বাইরে মানুষের মধ্যে মানুষ খুঁজেছেন, বিশ্বাস করেছেন যে সহমর্মিতার বৃষ্টিই পারে ধর্মদ্রোহের আগুন নেবাতে। কিন্তু এ মহাভারতে তেমন বৃষ্টি আর নামবে কি? ভয় হয়, স্রেফ ধর্মপরিচয়ের দায়ে কোটি কোটি মানুষকে সব বঞ্চনা অবিচার অপমান সহ্য করে মাথা নিচু করেই থাকতে হবে, শুধু টিকে থাকার তাগিদে। ২০২০-র গোড়ার কথা। ‘গোলি মারো সালোঁ কো’ আহ্বানে অনুপ্রাণিত দিল্লিতে তখন সংহারপর্ব জমে উঠেছে। জামিয়ার নুরনগরে এক বাড়িতে জড়ো হয়েছেন জ়েয়াদ এবং কয়েক জন। অনেক দিন পরে পুরনো বন্ধুদের দেখা হয়েছে, কিন্তু হাসি নেই, ঠাট্টাতামাশা নেই, স্মৃতিচারণা নেই। “কথা চলল কেবল এই নিয়ে যে, সামনের দিনগুলোতে কী করে বেঁচে থাকা যাবে।” অমৃতকালে যেমনটা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন
Advertisement