Book review: ধর্ম ও লৌকিকতা অঙ্গাঙ্গি হয়ে থাকে

জনসমাজ ও সংস্কৃতিতে যে ধর্মীয় অনুষঙ্গ মিশে থাকে, এবং নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সে সবের ব্যাপ্তি ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই বৃহদাকার এই সঙ্কলন।

Advertisement
দীপঙ্কর ঘোষ
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২১ ০৮:০৬

জেলার ভূভাগের সংযোজন বিয়োজনের পর ১৮৭২ সাল থেকে ১৩০ বছর মেদিনীপুর জেলার অখণ্ডতা বজায় ছিল। জেলার প্রশাসনিক চৌহদ্দি ২০০২ সালে ও ২০১৭ সালে ভাগ হয়ে বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম জেলা হয়েছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল, জঙ্গলমহল আর পলিমাটির উর্বরতায় সমৃদ্ধ— এই ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ড হওয়া সত্ত্বেও, অখণ্ড মেদিনীপুরের সাংস্কৃতিক সত্তার একাত্মতা আজও বোঝা যায়। সেই অস্তিত্বের প্রকাশ আছে ধর্মকথাতেও।

জনসমাজ ও সংস্কৃতিতে যে ধর্মীয় অনুষঙ্গ মিশে থাকে, এবং নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সে সবের ব্যাপ্তি ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই বৃহদাকার এই সঙ্কলন। শুধু পুজো-উপাসনার বিষয়ই নয়, মন্দির মসজিদ গির্জার স্থাপত্য, আরাধ্য দেবদেবীর মূর্তিরূপ, পূজাকেন্দ্রিক মেলা, আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক মেলামেশার নানা ধাঁচ নিয়েই আঞ্চলিক জনসমাজের ধর্মীয় যাপন। বৃহত্তর এই জনসমাজের ধর্মসংস্কৃতিরই তথ্যসন্ধানী পরিবেশনা করেছেন ভিন্ন ভিন্ন অন্বেষক। সাবেক মেদিনীপুরের ৫৪টি ব্লকভিত্তিক এই চর্চায় আছে এলাকাভিত্তিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের তথ্যতালিকা। প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার সঙ্কলন এবং দেড়শতাধিক রঙিন ছবিতে নথিভুক্ত এই বিস্তার। প্রসঙ্গত, সম্পাদক তাপস মাইতির উদ্যোগে ধারাবাহিক ভাবে মেদিনীপুরের নানা বিষয়ভিত্তিক সঙ্কলন প্রকাশিত হচ্ছে।

Advertisement

ব্লকভিত্তিক পঞ্চায়েত ও গ্রাম উল্লেখে ধর্মীয় স্থানের তালিকা ও দেবদেবীর নামবৈচিত্র দেখলে বোঝা যায় এই ভূভাগের বিস্তৃত ধর্মসংস্কৃতির ধারা। শুধু শাস্ত্রীয় দেবদেবীর কথা বা একেশ্বরবাদী ধর্মীয় উপাসনা নয়, অজস্র লৌকিক ও জনজাতীয় ধর্মবিশ্বাসের বৈচিত্র ফুটে উঠেছে এই সমীক্ষায়। পুটুবুড়া, কাঁকড়াসিনি, ললিতকুমারীর মতো লৌকিক দেবদেবীর কথা; বা হাতিধরা ও পাখিধরা ইত্যাদি মেলায় গেলে জানা যাবে আঞ্চলিক প্রকৃতি-পরিবেশে মানুষের যে প্রবহমান বিশ্বাসের ধারা, তার কথা। ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সীমানা এবং এ রাজ্যের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, হুগলি, হাওড়া ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা-বেষ্টিত এই বৃহত্তর ভূখণ্ড সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। ব্লকভিত্তিক লেখা কোনও কোনও ক্ষেত্রে বর্ণনাত্মক, আবার কোনও ক্ষেত্রে আছে পঞ্চায়েত বিভাগীকরণে আলোচনা।

পূর্ব-পশ্চিমে কোলাঘাট থেকে বেলপাহাড়ি, বা উত্তর-দক্ষিণে গড়বেতা থেকে দাঁতন— এই বিস্তৃত অঞ্চলে ধর্মপালনের বহু বিষয়ধারা জড়িয়ে আছে। তবে বেলপাহাড়ি যদি বিনপুর-২, লালগড় যদি বিনপুর-১ বা কোলাঘাট যদি পাঁশকুড়া-২ ইত্যাদি সংখ্যার আড়ালে চলে যায়, সে ক্ষেত্রে চর্চায় স্থানিক বিশেষত্ব অনেকাংশে অস্পষ্ট হয়ে যায়।

বড় কাজ, কিন্তু বহু বানান ভুল থেকে গিয়েছে। ব্রত ও সংশ্লিষ্ট আলপনা নিয়ে আলোচনা কোথায়? আবার, বর্ণানুক্রমিক ব্লকভিত্তিক আলোচনায় মিশে গেছে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম জেলার অঞ্চল। সে সব ব্লক বর্তমানে কোন জেলার অন্তর্গত, বহু লেখায় তারও উল্লেখ নেই।

তবু, এই গবেষণা-প্রয়াস ইতিহাস, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তি আর সমন্বয়ী ধারার আকর সূত্রের সন্ধান দেবে। কত গ্রাম; দেবস্থান ও মেলাপার্বণের বৈচিত্রও রকমারি। বিনপুর, লালগড়, ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়িতে জাহের থানের আধিক্য জনজাতীয় বসতির যেমন প্রামাণ্য নিদর্শন। সামগ্রিক ভাবে বড় চৌহদ্দির এই কাজটি জেলাচর্চায় বা বৃহত্তর আঞ্চলিক ধর্মসংস্কৃতির বৈচিত্র ও রূপান্তর অন্বেষণ। এমন বিষয়ভিত্তিক কাজ সম্মিলিত উদ্যোগে রূপায়ণের অনেক প্রতিকূলতা থাকে। তাই, সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চায় কর্মোদ্যোগের এই সফলতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন
Advertisement