Book review: দেবমূর্তির রূপের উৎস সন্ধানে

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দেবদেবীর আদল ও অবয়ব বদলে বদলে গিয়েছে। ফলে সুবিশাল এই দেশে নানা প্রত্নস্থলের দেবদেবীর চেহারা বদলের প্রতিও পাঠকের কৌতূহল স্বাভাবিক।

Advertisement
পার্থ দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:৪০

প্রত্নভাস্কর্যে দেবদেবী
প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
৫০০.০০
পত্রলেখা

সপ্তমাতৃকা, চৌষট্টি যোগিনী, নবগ্রহ ও বিবিধ মূর্তি-সহ আরও ২৮ দেবদেবীর প্রত্ন-নিদর্শনের আলোচনা আছে এই বইয়ে। ভারতে অগণিত দেবদেবীর জন্ম হয়েছে, কালে-কালে মনুষ্যকল্পিত রূপ বিবর্তিত হয়েছে। শিল্পী, স্থপতি, ধর্মপ্রচারক, শাসক— সবারই অবদান আছে এই দেবদেবীর মূর্তিকল্পনা, গঠন, অবস্থানে। পাশাপাশি মাধ্যমও (মূলত পাথর) এই মূর্তিরূপের নির্মাণ ও দৃশ্যকল্পে বড় ভূমিকা নিয়েছে। লেখক যে হেতু ‘প্রত্নভাস্কর্য’-এর কথা লিখেছেন, এই মূর্তির মাধ্যম বিচারও কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের কথায়, “মূর্তি বলিতে আমরা একটি প্রতীক বা নিদর্শন মনে করি। এই প্রতীক কোন্ ধর্মের কোন্ সভ্যতার কোন্ দর্শনের এবং কোন্ তত্ত্বের তাহা ঠিক করা মূর্তিবিদের কার্য।”

Advertisement

এই বইয়ে লেখক মূর্তিবিদের সেই কাজ করেছেন। প্রতিটি মূর্তির প্রসঙ্গে যেমন পুরাণকে আশ্রয় করেছেন, তেমনই শিল্পতাত্ত্বিকের অনুসন্ধিৎসা ও বিশ্লেষণেরও উদাহরণ পেশ করেছেন। উল্লেখ করা যায়— “স্বর্গ থেকে গঙ্গা নিয়ে আসার আরো বিশদ দৃশ্যের একটি ভাস্কর্য আছে ইলোরার কৈলাস গুহামন্দিরে। দৃশ্যটির উপর থেকে নেমে এসে গঙ্গা জলধারা হয়ে পৌঁছেছেন মহাকায় শিবের জটায়। তাঁকে দু’পাশ থেকে নিরীক্ষণ করছেন গগনচারী দেবতারা। মহাদেবের জটা থেকে মুক্ত হয়ে সেই জলধারা নেমে এসেছে আরো নীচে। সেখানে দর্শকের বাঁ-হাতি করজোড়ে উপবিষ্ট পুরুষটি সম্ভবত ভগীরথ রাজা। আরো নীচে একটি হাতি ও অশ্বের পাশ দিয়ে গঙ্গার স্রোত অগ্রসর হয়েছে যেদিকে, সেদিকে দেখা যায় করজোড়ে দণ্ডায়মান সাত ঋষির মূর্তি। এই দৃশ্যে মহাদেব দাঁড়িয়ে আছেন উপুড় হয়ে বসে থাকা একটি মানুষের পিঠে। শিবঠাকুরের বাঁয়ে বঙ্কিম দেহবিভঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষীণকটি, তন্বী, সুস্তনী এবং দীঘলচরণ নারীর পার্বতী হওয়া সম্ভব। তবে, সদ্য দেবাদিদেবের পত্নী হিসেবে গৃহীত গঙ্গাদেবী হওয়াও অসম্ভব নয়।” এমন বর্ণনায় পাঠককে তাঁর পাশে দাঁড় করিয়ে দেন লেখক।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দেবদেবীর আদল ও অবয়ব বদলে বদলে গিয়েছে। ফলে সুবিশাল এই দেশে নানা প্রত্নস্থলের দেবদেবীর চেহারা বদলের প্রতিও পাঠকের কৌতূহল স্বাভাবিক। লেখক এই বদলে যাওয়ার সূত্রগুলিকে যথাসাধ্য ধরার চেষ্টা করেছেন, তবে তা আলাদা পরিচ্ছেদে নির্দিষ্ট তালিকা আকারে পেশ করা হলে ভাল হত। কারণ, এই বদলগুলি যেমন ভাস্কর্য-মাধ্যম আশ্রিত, তেমনই শিল্পশৈলী আশ্রিতও বটে। আর, ভারতের প্রত্নক্ষেত্রের গর্ভগৃহের মূর্তির তুলনায় দেওয়াল-অলিন্দের মূর্তির বিভিন্নতা ও শিল্পসুষমাও অনন্যসাধারণ, এই বইয়ে তার অনুপুঙ্খ বিচারও আছে, কিন্তু সামান্য স্থাপত্যসূত্র সহযোগে। দেবদেবীর মূর্তিতে অসুন্দরের উপস্থিতি নেই। কিন্তু সরলরেখা বক্ররেখার চলন আছে। পাশাপাশি ভগ্নপ্রায় মূর্তির পূর্ণ আলোকচিত্রের তথ্যও আমাদের কাছে নেই, তাই সেই অবস্থা মেনে নিয়েই তার ভঙ্গিমা নির্ভর করে আলোচনার আয়োজন করতে হয়। শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মরণীয়: “আর্টের মজা এই যে, পাথরের একটা মূর্তির হাত ভেঙে যাক তবু মূর্তিটা লাগবে সুন্দর, কারিগরের গড়া পুতুল তিল তিল সৌন্দর্যের বাসা।”

পাঠকের কাছে এই জাতীয় বইয়ের আকর্ষণ তার ছবিও। কবে আমাদের প্রকাশকরা যথাযথ আলোকচিত্র মুদ্রণে যত্নবান হবেন, সে আশায় রয়েছি। পাশাপাশি, মুদ্রণপ্রমাদ ও চিত্রসঙ্কেতের ভ্রান্তিও পীড়া দেয়। তবু বাংলা ভাষায় ভারতীয় দেবদেবীর উৎসকথনে এ বই গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন
Advertisement